বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 8:28 pm
October 29, 2025 8:28 pm

ঢাকার নিঃশব্দ দেয়াল: সমকামী তরুণদের জীবন ও ভয়

ধীরে ধীরে ঢাকার সরু রাস্তায়, চকমকে আলো ঝলমল করছে না। রাতের আধারে হাওয়া ভারী, যেন প্রতিটি নিঃশ্বাসেই শহরের চাপ অনুভূত হয়। আমি Sadia Sharmin Aysha, এবং আজকের এই রিপোর্টটি আমি ঢাকার এক প্রান্তিক এলাকার তরুণ সমকামী মানুষের জীবন নিয়ে লিখছি। নাম প্রকাশ করা যাবে না, কারণ প্রকাশিত হলে তার জীবন বিপদে পড়তে পারে। আমি তাকে ‘রায়ান’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি।

রায়ান ২৫ বছর বয়সী একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। ঢাকার এক বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে, কিন্তু তার জীবনের বড় অংশটি নীরবতায় কাটে। অফিসে সে সবসময় হাসি মুখে, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে, কিন্তু যখন বাড়ি ফিরে আসে, তখন তার সেল ফোনের লক স্ক্রিনে শুধু নিরাপত্তা আইকন নয়, তার নিজের অভ্যন্তরীণ ভীতির প্রতীক। পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো, superficially। বাবা-মা জানে না যে সে সমকামী। জানা হলে তারা হয়তো শারীরিকভাবে বা মানসিকভাবে আঘাত দিতে পারে — এটা তার ভেতরের ভয়, এবং সে জানে শহরের বাইরে থেকেও পরিবারের চোখে সে ‘ভ্রান্ত’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

রায়ান আমাকে প্রথমবার তার শাড়ি কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ হাতে দেখা করার সময় বলেছিল, “আমি চাই না কেউ জানুক, আমি কে। আমি শুধু জীবনটা কিছুটা স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই।” আমি বুঝি, এই কথা একধরনের ক্ষুধার্ত আবেদন — সত্য বলার ইচ্ছা এবং নিরাপদ থাকার আকাঙ্ক্ষা একসাথে।

তার অফিসের পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। সহকর্মীরা মাঝে মাঝে ফিসফিস করে হেসে বলে, “দেখো, সে আবার কারও দিকে তাকাচ্ছে।” হাসি মুখে তারা ভদ্রতার ল্যাবেল দেয়, কিন্তু ভেতরে রয়েছে নির্যাতনের এক ছোট্ট চুম্বক। কেউ কখনো সরাসরি আক্রমণ করে না, কিন্তু পরিবেশের নিঃশব্দ চাপ এতটাই যে, রায়ান শুধু নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য।

ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ও রায়ান এই ধরনের দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়েছিল। ছাত্র সংসদে একটি সমকামী বন্ধুর সঙ্গে বসা মানেই ছিল চুপচাপ নীরব থাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে কখনও কখনও তারা কথা বলত, কিন্তু সেই মুহূর্তগুলোও ছিল অস্থির, যেন কেউ তাদের পর্যবেক্ষণ করছে। তখনও ভয় ছিল, কিন্তু তখন বিষয়টা ছিল বন্ধুদের মধ্যে সীমিত। এখন বিষয়টি বেড়েছে।

আমি যখন তার সঙ্গে একদিন রাতের চা দোকানে বসে কথা বললাম, রায়ান বলল, “শহরে হাঁটতে গেলে মনে হয়, কেউ সবসময় আমার দিকে তাকাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারবে না, কিন্তু আমার মনে হয় প্রতিটি চোখ আমাকে বিচার করছে।” তার চোখে ক্লান্তি, এক প্রকারের মানসিক চাপ, যা সহজে ভুলে যায় না।

তার বন্ধু সিফাতও একই পরিস্থিতির শিকার। সিফাত ২৮ বছর বয়সী, একজন আইটি প্রকৌশলী। তার বাবা-মা গ্রামে থাকেন। সিফাত ঢাকায় এসে পড়েছে স্বাধীনতার আশায়, কিন্তু স্বাধীনতাও কখনোই পুরোপুরি মুক্তি দেয় না। অফিসে সহকর্মীদের ছোঁয়াচে হাসি, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে মৃদু তাচ্ছিল্য—সব মিলিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেখানে সে আত্মবিশ্বাসীভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না।

একদিন আমি তার অফিসে গোপনে প্রবেশ করি। ডেস্কে আমি দেখি তার কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটি নোট লেখা, “আমার পরিচয় জানলে কেউ আমাকে ভালোবাসবে না, আমার কাজ নষ্ট হবে।” এটি কোন নাটক নয়, বাস্তবতার প্রতিফলন।

ঢাকার পারিবারিক উৎসবগুলোও সমস্যা সৃষ্টি করে। ঈদে বা পহেলা বৈশাখে পরিবারের সঙ্গে রায়ানকে অংশ নিতে হয়, কিন্তু সে সবসময় এমন কাজ করে যেন নিজেকে সামাজিক দৃষ্টিতে ‘নিরপদ’ রাখে। পরিবারের মধ্যে ছোটখাটো প্রশ্ন—“তোমার বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় যাও?”—তার জন্য ঝড়ের সমান। সে জানে, এক মুহূর্তের অবহেলা পুরো জীবনের দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে।

এবং ভয় সবসময় ব্যক্তিগত নয়; শহরের রাজনীতি, ধর্মীয় সামাজিক প্রভাবও তার জীবনে চাপ সৃষ্টি করে। কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে সমকামী পরিচয় প্রকাশ করার মতো সাহস নেই। এখানে প্রকাশ্য আক্রমণ হয় না, কিন্তু সামাজিক দৃষ্টি, ফিসফিস করা মন্তব্য, ছোট্ট আক্রমণ—সবই জীবনকে সীমিত করে দেয়।

আমি রায়ানকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি কি কখনো কাউকে বলেছো?” সে বলেন, “শুধু এক বন্ধুকে। তবে সে বন্ধুরাও সমাজের চোখে নিরাপদ নয়। তাই পুরোপুরি লুকানোই নিরাপদ।” এই কথাগুলো পড়লে বোঝা যায়, নিরাপত্তা ও স্বতন্ত্রতার মধ্যে কি ফাঁক আছে, যেখানে জীবন যাপন মানেই নীরবতার কষ্ট।

এই প্রতিবেদনে শুধু রায়ানের গল্পই নয়; এমন অনেক যুবক-যুবতী ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে এক নিঃশব্দ যুদ্ধে লিপ্ত। কেউ সাংবাদিককে সাক্ষাৎ দিতে সাহস পায় না, কেউ সামাজিক অনুষ্ঠানে হাসিমুখে অংশ নেন, কিন্তু ঘরে ফিরলেই নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। আমি যখন তাদের সঙ্গে কথা বলি, প্রতিটি মুখে এক ধরনের মানসিক ক্লান্তি, অব্যক্ত ভয়, এবং প্রতিদিনের দ্বন্দ্বের ছাপ দেখা যায়।

একটি সকালে আমি রায়ানের সঙ্গে অফিসে গেলে দেখি সে ডেস্কে বসে চুপচাপ কাজ করছে। পাশের সহকর্মী হেসে বলে, “দেখ, আবার কাকে মেসেজ করছে।” রায়ান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, কিন্তু তার চোখে নিরব প্রতিবাদ। এই দৃশ্য শুধু রায়ানের নয়; পুরো শহরের একটি বৃহৎ অংশের তরুণদের জন্য বাস্তবতা।

এই রিপোর্টের মূল বিষয় হচ্ছে—সমকামী মানুষদের সামাজিক বাস্তবতা একদম সহজ নয়। তারা প্রতিবাদ করতে চায়, তবে প্রতিবাদ মানে আত্মপ্রকাশ, আর আত্মপ্রকাশ মানে সামাজিক হুমকি। এখানে আইন প্রয়োগ নেই, সামাজিক স্বীকৃতি নেই, পরিবার ও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে দ্বিচারিতা আছে।

ঢাকা শহরে সমকামী মানুষদের জন্য সামাজিক ভয় একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছে। অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, পারিবারিক অনুষ্ঠান, এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা—সবই নিয়ন্ত্রিত। নীরবতার এই দেয়াল প্রতিটি পদক্ষেপে দেখা যায়, প্রতিটি কথায় শোনা যায়।

আমি রায়ানকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি কি ভাবো, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলাবে?” সে হেসে বলে, “শুধু চাই কেউ আমাকে যেন বিচার না করে। আশা খুব বেশি বড় নয়।” এই আশা আর ভয়—এটাই ঢাকা শহরের অনেক সমকামী তরুণের জীবনের একমাত্র প্রতীক।

রিপোর্টের জন্য সাক্ষাৎকার নেওয়া অবস্থায় আমি লক্ষ্য করি, কোনো মানুষ আক্রমণ করে না, কেউ হাসি ঠেসে বলছে—তবে এই নিঃশব্দ চাপ জীবনকে নরম করে, সাহস কেড়ে নেয়। আমি বুঝতে পারি, প্রতিবাদের সুযোগ নেই, প্রকাশের সাহস নেই, কিন্তু নীরবতাই তাদের প্রতিদিনের কষ্টের সাক্ষী।

এই রিপোর্টের শেষ ভাগে আমি লিখি—ঢাকার সমকামী তরুণরা শুধু জীবন্ত, তারা দেখাচ্ছে এক বাস্তবতা। সমাজ যদি তাদের প্রকাশ, স্বীকৃতি, ও নিরাপত্তা দিতে না পারে, তবে সত্য বলার মানে থাকে না। এই সত্য প্রকাশই এক ধরণের সাহস, যা তাদের নীরবতা ভাঙে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *