বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 30, 2025 1:05 am
October 30, 2025 1:05 am

বাংলাদেশে মানবাধিকার: সরকার বদলেছে, অন্যায় বদলায়নি

Md. Emdadul Hoque Chowdhury

শাসক বদলেছে, দলীয় পতাকার রং বদলেছে, কিন্তু নাগরিকের নিরাপত্তা, বিচারব্যবস্থা এবং মানবাধিকারের অবস্থা আগের মতোই ভয়াবহ। অন্তর্বর্তী সরকারও এই ভয়ঙ্কর চক্র ভাঙতে পারছে না, আর দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে নৈতিক দায়ের শূন্যতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চক্রকে আরও গভীর করছে। এই রাজনৈতিক দল দিয়ে দেশ এবং জাতির কি হবে?

বাংলাদেশ আজ এক অদ্ভুত পর্যায়ে দাঁড়িয়ে। একনায়কতন্ত্রের পতনের পর মানুষ ভেবেছিল, এবার হয়তো শ্বাস নেওয়া যাবে, সত্য বলা যাবে, আর ভয়ের রাজনীতির অন্ধকার কমবে। কিন্তু ২০২৫ সালের বাস্তবতা দেখাচ্ছে—রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, কিন্তু দমননীতি, বিচারহীনতা ও মানবাধিকারের অবমাননা কেবল নতুন রূপ ধারণ করেছে।

শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামল ছিল ভয়, রক্ত আর শাসনযন্ত্রের যুগ। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব বলছে—তাঁর শাসনামলে শত শত মানুষ “ক্রসফায়ার”-এ নিহত, ডজন ডজন নিখোঁজ, এবং হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী কারাগারে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সাংবাদিকরা নীরব হয়ে পড়েছিলেন; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছায়ায় সত্য বলা ছিল অপরাধ। রাষ্ট্রের যন্ত্র তখন জনগণের নয়, একদলীয় ক্ষমতার সেবায় নিয়োজিত ছিল।

এই ভয়াবহতার দায় শুধু আওয়ামী লীগের নয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালেও একই ধরনের দমননীতি চালিয়েছে—বিরোধীদের ওপর হামলা, গ্রেফতার, এবং বিচারহীনতা তাদের আমলেও স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। জাতীয় পার্টি ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোও রাজনৈতিক সহিংসতার সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করেছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিজেই মানবাধিকারের শত্রু।

২০২৪–২৫ সালের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে—নাগরিকদের নতুন আশা জাগিয়ে। তবে বাস্তবতা বলছে, মানবাধিকারের লঙ্ঘন এখনও অব্যাহত। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন ২০২৫ সালের রিপোর্টে জানিয়েছে, “বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের পরও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বন্ধ হয়নি। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে আগের দমননীতির ছায়া এখনো বিরাজ করছে।”

উদাহরণ স্বরূপ, ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী সংগঠিতভাবে দমন চালিয়েছে। Human Rights Support Society (HRSS) জানাচ্ছে, এ সময়ে অন্তত ৪৭ জন নিহত ও ২,৪৭৫ জন আহত হয়েছেন। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানি চলে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরও হামলা কমেনি। Global Coalition for Democracy and Justice রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪–২৫ সালের মধ্যে ২,৪৪২টি হামলার ঘটনা হয়েছে, যেখানে বাড়ি, পূজামণ্ডপ ও মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে।

দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের Enforced Disappearance Prevention and Redress Ordinance ২০২৫ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করছে না। “দ্রুত বিচার ও স্বাধীন তদন্তের নিশ্চয়তা নেই,” তারা সতর্ক করেছে। HRW-ও বলেছেন, “নিরাপত্তা বাহিনী সহজে দায়বদ্ধ হয় না। কার্যকর সংস্কার ছাড়া মানবাধিকার সংকট অব্যাহত থাকবে।”

বিচারব্যবস্থা আজও রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়ায়। সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ দীর্ঘমেয়াদে বিচারহীন থাকে, আর প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা দায়মুক্ত। আদালত আর ন্যায়বিচারের প্রতীক নয়, বরং ক্ষমতার আশ্রয়। অন্তর্বর্তী সরকারও এই ভাঙা কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে—সংস্কার বা জবাবদিহিতার কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেই।

সাংবাদিকদের স্বাধীনতা বর্তমান সরকারের অধীনে তুলনামূলকভাবে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংশোধনের ফলে কিছু সাংবাদিক নির্ভয়ে কাজ করছেন। কিন্তু মিডিয়ার এই সীমিত স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়। মাঠে এখনো দেখা যায়—যে সাংবাদিক দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেন, তারা হুমকি বা হয়রানির মুখে পড়েন। মানুষ এখনও ভয় পেয়ে সত্য বলার পথে ঝুঁকি নিতে বাধ্য।

রাজনৈতিক দলগুলোও মানবাধিকার রক্ষায় দায়বদ্ধ নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিরোধী দমন, বিএনপি থাকলে প্রতিশোধমূলক সহিংসতা। জাতীয় পার্টি, ধর্মভিত্তিক ও বাম দলগুলোও রাজনৈতিক দ্বিচারিতা চালিয়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার সব দলের কাছে কেবল সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ; নাগরিকদের মৌলিক অধিকার তারা ব্যবহার করছে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ২০২৫ রিপোর্টে জানিয়েছে, “বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত ক্ষমতা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।” ইউরোপীয় ইউনিয়নও হুঁশিয়ারি দিয়েছে—মানবাধিকার অগ্রগতি না হলে GSP+ সুবিধা পুনর্বিবেচনা করা হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন বলেছে, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বন্ধ না হলে বাংলাদেশ আরও গভীর সংকটে পড়বে।

মানবাধিকার রক্ষায় পথ আছে, কিন্তু সাহস হারানো হয়েছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।

– স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা, যেখানে অতীত ও বর্তমান সরকারের অধীনে সংঘটিত সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত হবে।

– নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার, মানবিক প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

– বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

– রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে সর্বদলীয় চুক্তি তৈরি করা।

– মিডিয়া ও নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পূর্ণভাবে সংরক্ষণ করা।

বাংলাদেশের মানুষ এখনও সেই শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে। ন্যায়বিচারের পথ বেছে নিলে বাঁচা সম্ভব, অন্যথায় চুপচাপ থাকলে রাষ্ট্র ধ্বংসের দিকে এগোবে।

শেষ কথা:

মানবাধিকার কেবল বক্তৃতার বিষয় নয়, নাগরিকের মৌলিক অধিকার। যে রাষ্ট্র নিজেকে রক্ষা করতে নাগরিককে ভয় দেখায়, সে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই ধ্বংসের মুখে। বাংলাদেশের এখন সময় এসেছে—নাগরিক, আদালত, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একযোগে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার।

লিখেছেনঃ Md. Emdadul Hoque Chowdhury

মানবাধিকার কর্মী  লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *