বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 9:56 am
October 29, 2025 9:56 am

নারীর স্বাধীনতার পথে ধর্মীয় গোঁড়ামির বাঁধা

Rafia Akther

বাংলাদেশে নারী আজো দুই পৃথিবীর মাঝে আটকে আছে—একদিকে সে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে, অন্যদিকে সমাজের গভীরে গেঁথে থাকা ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও সামাজিক ভণ্ডামি তাকে টেনে নামাতে ব্যস্ত। যে মেয়েটি স্কুলে যায়, শহরে চাকরি করে বা সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে যায়, সে প্রতিনিয়ত শুনে—‘এটা হারাম’, ‘ওটা পাপ’, ‘নারীর জায়গা ঘরে’। কিন্তু এই কথাগুলোর ভিত্তি কোথায়? ধর্মের নামে নারীর উপর আরোপিত এই নিয়মগুলো কি সত্যিই ধর্মের শিক্ষা, নাকি পুরুষতন্ত্রের তৈরি এক প্রাচীন শৃঙ্খল, যেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের ছদ্মবেশে শক্ত হয়েছে?

আমাদের সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি এখন এমন এক অদৃশ্য প্রাচীর, যা নারীকে তার নিজের অস্তিত্ব নিয়েই লজ্জিত করে তুলেছে। সে যদি নিজের শরীর, নিজের অধিকার, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়েও কথা বলতে চায়, তাকে সঙ্গে সঙ্গে ‘অশালীন’, ‘অবিশ্বাসী’, বা ‘ধর্মবিরোধী’ তকমা দেওয়া হয়। এই সমাজ নারীর মুখ বন্ধ রাখতেই যেন বেশি আগ্রহী, কারণ নারীর কণ্ঠস্বর মানে প্রশ্ন—আর প্রশ্ন মানেই প্রতিষ্ঠিত ভণ্ডামির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

ধর্মীয় গোঁড়ারা সব সময় নারীর স্বাধীনতাকে ভয় পায়। কারণ, নারী যদি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখে, তবে সমাজের ভুয়া শ্রেষ্ঠত্ববোধ টিকে থাকতে পারে না। নারীর স্বাধীনতা মানে শুধুই পর্দা খুলে ফেলা নয়, বরং নিজের মস্তিষ্কের পর্দা সরিয়ে ফেলা। ধর্মের নামে আজ যে অন্ধকার তৈরি হয়েছে, সেখানে নারীকে বলা হয়—‘তুমি দুর্বল’, ‘তুমি ফিতনা’, ‘তুমি প্রলোভন’। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে—এই নারীই পরিবার চালায়, সন্তান লালন করে, সমাজে শ্রম দেয়। কিন্তু পুরুষতন্ত্র চায় না, নারী নিজের শক্তি বুঝতে পারে।

বাংলাদেশে যতই আইন তৈরি হোক, নারীর নিরাপত্তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। একজন নারী রাস্তায় বেরোলে, বাসে উঠলে, এমনকি নিজের কর্মক্ষেত্রেও নিরাপদ নয়। অথচ একই সময়ে ধর্মীয় বক্তারা নারীকে উপদেশ দেন—‘নিজেকে ঢেকে রাখো’, ‘ঘর থেকে কম বের হও’। প্রশ্ন হলো, নারীর নিরাপত্তার দায়িত্ব কেবল তার পোশাকের উপর কেন? পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নয় কেন? সমাজে পুরুষের শিক্ষা, নৈতিকতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে এত কম আলোচনা হয় কেন?

ধর্মীয় বক্তৃতার মঞ্চগুলোতে প্রতিদিন যে ভাষায় নারীকে হেয় করা হয়, তা শুনে বোঝা যায় না আমরা একবিংশ শতাব্দীতে আছি। কিছু মৌলবাদী বক্তা নারীর গলার আওয়াজকেও পাপ বলেন, মেয়েদের হাসিকে ‘ফিতনা’ বলেন, আবার নিজেদের সুবিধামতো ধর্মের আয়াত টেনে এনে প্রমাণ দিতে চান—নারীর অধিকার মানেই সীমাবদ্ধতা। অথচ একই ধর্মে নারীর সম্মান, সমান অধিকার, শিক্ষার সুযোগের কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। সমস্যা ধর্মে নয়, সমস্যা তাদের মধ্যে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে নারীকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানায়।

ধর্মীয় গোঁড়ামি শুধু মসজিদ বা মাদ্রাসায় সীমাবদ্ধ নয়; এটা আমাদের সংসার, স্কুল, টেলিভিশন, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে। নারীর পোশাক, হাঁটাচলা, কথা বলা, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় তার উপস্থিতি নিয়েও মন্তব্য আসে—‘ধর্ম মানে না’, ‘লজ্জা নেই’। এই সমাজ যেন নারীর প্রতিটি পদক্ষেপের পাহারাদার। অথচ এই পাহারাদারির আড়ালে চলছে নারীর প্রতি মানসিক ও শারীরিক সহিংসতা, যেগুলো নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না।

ধর্মীয় গোঁড়ারা সবসময় বলেন, নারীকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নারী কি নিজের রক্ষার অধিকার রাখে না? একজন নারী যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাকে ‘বিদ্রোহী’ বলা হয়। যদি সে যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলে, তখন সমাজ তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যদি সে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়—বিয়ে, পেশা, পোশাক—তাহলে বলা হয়, ‘ধর্মের বাইরে চলে গেছে’। এইভাবে নারীর উপর মানসিক চাপ, অপরাধবোধ, ভয়—সব একসঙ্গে চাপিয়ে দেওয়া হয়।

আমাদের দেশে অনেক নারী আজো ধর্মীয় ভয়ে নিজের স্বপ্ন মেরে ফেলছে। কেউ চায় গানের জগতে যেতে, কেউ চায় খেলাধুলায়, কেউ বিজ্ঞানী হতে চায়—কিন্তু পরিবার বলে, ‘ওসব মেয়েদের জন্য না’। এই ‘মেয়েদের জন্য না’ কথাটাই আসলে গোঁড়ামির সবচেয়ে বিষাক্ত বীজ। কারণ, সমাজ যেদিন বুঝবে—কোনো পেশা, কোনো জ্ঞান, কোনো স্বপ্ন কেবল পুরুষের সম্পত্তি নয়, সেদিনই নারী সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হবে।

ধর্মকে সম্মান করা আর ধর্মের নামে অন্ধ আনুগত্য দেখানো—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। আমরা ধর্মকে মানবতার জন্য চাই, অমানবিকতার জন্য নয়। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদীরা চায় মানুষ যেন চিন্তা না করে, প্রশ্ন না করে, শুধু অনুসরণ করে। আর সেই অনুসরণের বোঝা প্রথমে চাপানো হয় নারীর উপর। কারণ তারা জানে, নারী যদি প্রশ্ন করতে শেখে, তবে পরিবারের ভেতর থেকে শুরু হবে পরিবর্তন।

আজকের প্রজন্মের নারীরা আর আগের মতো নীরব নয়। তারা কথা বলছে, লিখছে, প্রতিবাদ করছে। কিন্তু তবু সমাজ তাদের ভয় দেখায়—‘তুমি নাস্তিক হয়ে যাচ্ছ’, ‘তুমি পশ্চিমা চিন্তায় ভেসে গেছ’। আসলে এই ভয় দেখানোই পুরনো কৌশল—যাতে নারী নিজের চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, যে সমাজে নারী শিক্ষিত, মুক্ত ও সচেতন, সেই সমাজই সবচেয়ে স্থিতিশীল ও উন্নত।

নারীর প্রতি অন্যায়, বৈষম্য, সহিংসতা—এসব শুধু আইনের মাধ্যমে থামানো সম্ভব নয়, যদি না সমাজের মনস্তত্ত্ব পরিবর্তন হয়। আর এই পরিবর্তন আসবে শিক্ষা ও সাহসের মাধ্যমে। ধর্মের নামে যে ভয় তৈরি করা হয়েছে, সেই ভয় ভাঙার দায়িত্ব এখন প্রতিটি সচেতন নারীর। যে নারী নিজের কণ্ঠ তুলবে, সে একদিন অন্য নারীকেও সাহস দেবে।

ধর্মীয় গোঁড়ামি যে শুধু নারীর পথ রুদ্ধ করছে তা নয়, তা পুরো সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা। কারণ, যখন অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ভয়ে, অপরাধবোধে ও শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা হয়, তখন একটি জাতি কখনো পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে না। আজ বাংলাদেশে যত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পই হোক না কেন, যদি নারী তার চিন্তা, মতামত, স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে না পারে, তবে এই উন্নয়ন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

ধর্ম কখনো নারীর শত্রু নয়—শত্রু হলো সেইসব মানুষ, যারা ধর্মকে ব্যবহার করে নারীকে ভয় দেখায়। এই সমাজে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ধর্মের আসল বার্তা বোঝা—যেখানে আছে সমতা, মানবতা ও সহমর্মিতা। একজন নারী যদি নিজের চিন্তা, বিশ্বাস ও স্বাধীনতার জায়গা থেকে বাঁচতে চায়, তবে সেটাই প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতিফলন।

আজ প্রয়োজন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক সামাজিক জাগরণ—যেখানে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে বলবে, ধর্ম মানে ভালোবাসা, ঘৃণা নয়; ধর্ম মানে ন্যায়, অন্যায় নয়; ধর্ম মানে মুক্তি, বন্দিত্ব নয়।

একজন নারী হিসেবে আমি জানি, এই পথ সহজ নয়। কিন্তু প্রতিটি কঠিন পথেই আলো থাকে, যদি কেউ সেই পথে হাঁটার সাহস দেখায়। নারীর মুক্তি শুধু তার নিজের নয়, এটা পুরো সমাজের মুক্তি। আর সেই মুক্তি আসবে যখন আমরা সবাই ধর্মীয় গোঁড়ামির অন্ধকার পেরিয়ে মানবতার আলোয় দাঁড়াতে পারব।

লিখেছেন- রাফিয়া আখতার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *