বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার মানবাধিকার আদর্শ নিয়ে। সংবিধান বলেছিল, “সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে, ধর্মভেদে কোন বৈষম্য চলবে না।” অথচ আজকের বাস্তবতা যেন উল্টো গল্প বলে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদেও বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী দেশ। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়— এই প্রতিশ্রুতিগুলো কি কেবল কাগজে লেখা থাকবে, নাকি বাস্তবে তার কোনো মূল্য আছে?
অগাস্ট ২০২৪ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যেসব হামলা হয়েছে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং একটি ধারাবাহিক বাস্তবতা। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে দুর্গোৎসবের আগে প্রতিমায় আগুন দেওয়া হলো গভীর রাতে। ফরিদপুরে মন্দির ভাঙচুর হলো কোনো প্রমাণ রাখার আগেই। ঢাকার খিলক্ষেতে প্রতিমা ভাঙা হলো সিসিটিভি ক্যামেরার সামনেই, যেন এ এক প্রকাশ্য ঘোষণা— “কেউ আমাদের আটকাবে না।”
এসব ঘটনার পর প্রশাসন যা করলো, তা আরও হতাশাজনক। মামলা হয়েছে, কিন্তু গ্রেপ্তার নেই। তদন্ত হয়েছে, কিন্তু বিচার নেই। নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসেছে, কিন্তু বাস্তবে পাহারা নেই।
রাষ্ট্র কি তবে শুধুই বিবৃতি দেওয়ার জন্য?
সাম্প্রতিক ঘটনা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর তীব্র হামলা
২০২৪-২০২৫ সালে আমরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর বিপুল সংখ্যক নির্যাতন দেখেছি। নীচের গ্রাফটি কেবল একটি উদাহরণ।
- গাইবান্ধা, সাদুল্লাপুর: কামারপাড়া মন্দিরে পাঁচটি প্রতিমা অগ্নিসংযোগে পুড়ে যায়।
- ফরিদপুর, খাসকান্দি: কালীমূর্তি ও দুর্গাপ্রতিমা ভাঙচুর।
- ঢাকা, খিলক্ষেত: মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং উচ্ছেদ।
- মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ: ১৪টি পূজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর।
- লক্ষ্মীপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ: হাজারের বেশি মন্দিরে সহিংসতা।
করুন বাস্তবতা হলো ২০২৪–২০২৫ সালের মধ্যে প্রায় ১৫,০০০ সংখ্যালঘু পরিবার সহিংসতার শিকার, এবং ৫০০+ নারী ও তরুণী যৌন সহিংসতার শিকার।
তাহলে প্রশ্ন হলো—রাষ্ট্র কি কেবল আক্রমণের দর্শক, নাকি কখনো কখনো সহায়তাকারীও?
রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ব্যর্থতা
বর্তমান সরকার ও প্রশাসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসনের উদাসীনতা, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার বা বিচারের অভাব, এবং হামলাকারীদের শাস্তি না দেওয়া — সবই সহিংসতাকে আরও উৎসাহিত করেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর এবং যৌন সহিংসতার ঘটনা প্রমাণ করছে, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে না। অথচ একটি সরকার ও প্রশাসনের মৌলিক কর্তব্য হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষা করা, যা কার্যত উপেক্ষিত হয়েছে।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এই প্রশ্নের উত্তর দিবেন কি, তারা বলেন এখন মানবাধিকার সুরক্ষা হচ্ছে তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার কোথায় গেলো?
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা—সহানুভূতি নাকি সুবিধাবাদ?
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হলে সব দলের পক্ষ থেকেই নিন্দা আসে। কেউ বলে, “এটি ষড়যন্ত্র।” কেউ বলে, “দোষীদের চিহ্নিত করা হবে।” কিন্তু চিহ্নিত হওয়ার পর তাদের বিচার পর্যন্ত যায় না কেন? আসলে সংখ্যালঘুরা এই দেশে “মানুষ” নয়—তাদের দেখা হয় “ভোটের মালামাল” হিসেবে। যখন নির্বাচনের সময় আসে তখন তাদের দরকার পড়ে ভোট ব্যাংক বৃদ্ধির জন্য, “ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ” দেখানোর জন্য। আর যখন তারা আক্রান্ত হয়, তখন সব দলই বলে “খুব দুঃখজনক”, এবং আরো এগিয়ে বলে এটা সরকারের ব্যর্থতা”—তারপর সবাই চুপ। কারণ সব দলই সংখ্যালঘুদের বাঁচাতে চায় না—তাদের মৃত্যু ও নির্যাতনকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায়। কেউ সুরক্ষা দেয় না, কেবল সহানুভূতির নাটক করে।
বিএনপি, জামায়াত, ইসলামমুখী রাজনৈতিক দলগুলো বারবার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথা বলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো— তাদের কাছে কি সংখ্যালঘু সুরক্ষার কোনো বাস্তব রূপরেখা আছে? এখনো পর্যন্ত কোনো প্রস্তাবিত নীতিপত্রে তাদের নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ বা আইনি সুরক্ষা নিয়ে স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন পক্ষও “ধর্মীয় সম্প্রীতি”র কথা বললেও, বাস্তবে তার প্রমাণ দেখা যাচ্ছে না। পাহারা দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু ইচ্ছা আছে কি?
মৌলবাদী শক্তির উত্থান—রাষ্ট্রের নীরব সম্মতি?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, আগস্ট ২০২৪-এর পর মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে মসজিদের লাউডস্পিকার পর্যন্ত ব্যবহার করছে।তাদের মূল বার্তা সহজ—ভয় দেখাও, মালিকানা ঘোষণা করো। আর রাষ্ট্র? তারা তাকিয়ে থাকে। মামলা নেয়, কিন্তু বন্ধ করে ফেলে। গ্রেপ্তার করে, কিন্তু জামিন দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রমাণ চাই? গত এক বছরে ২ হাজারের বেশি মন্দিরে হামলা আর ১৫ হাজারের বেশি সংখ্যালঘু পরিবার নিপীড়নের শিকার—এটা কি কেবল কাকতালীয়?
যারা বলে “এটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত নয়”, তারা হয় অন্ধ, নয়তো সুবিধাভোগী। এটাই কি তবে পরোক্ষ অনুমোদন নয়?
আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ
- যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- যুক্তরাজ্য: সরকারী Country Policy note অনুসারে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতা স্পষ্ট।
- ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবাধিকার কমিশন প্রকাশ করেছে, “বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে উপাসনালয় ও সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, শুধু নিন্দা নয়।”
- জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষার চারটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে; কিন্তু তার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান নয়।
এই সমস্ত আন্তর্জাতিক নোট শুধু সতর্কবার্তা নয়; তারা বাংলাদেশের সরকারের কাছে মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার বাস্তবায়নের তীব্র আহ্বান করছে।
গণতন্ত্র কি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য?
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল মানবাধিকারের প্রশ্ন নয়; এটি ডেমোক্র্যাটিক সিস্টেমের মৌলিক ভিত্তি। গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা না হলে রাষ্ট্রের নৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো—সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, বরং সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
যে রাষ্ট্র তার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারে না, সেই রাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিপূর্ণ নয়। সংখ্যালঘুদের অধিকার শুধু সহানুভূতির বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও নৈতিকতার পরিমাপক।
এখন কী করা উচিত?
১. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল—সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার জন্য আলাদা আদালত স্থাপন।
২. ক্ষতিগ্রস্ত উপাসনালয় পুনর্গঠন ফান্ড—রাষ্ট্রের অর্থায়নে।
৩. রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্যতামূলক নীতি-ঘোষণা—প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে সংখ্যালঘু সুরক্ষা নীতিমালা প্রকাশ করতে হবে।
৪. মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহনশীলতার পাঠ বাধ্যতামূলক করা।
৫. অভিযুক্তদের রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া থেকে মুক্ত রাখার নিশ্চয়তা।
এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত হবে, যেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
উপসংহার
বাংলাদেশ কি সেই দেশ, যেখানে সংখ্যালঘুরা ভয়ে নিজ ঘরে উৎসব পালন করবে? যেখানে একজন শিশুকে ধর্ম পরিচয়ে আলাদা করে দেখা হবে? এ দেশ এমন ছিল না। এ দেশ এমন হওয়ার কথা নয়।
মৌলবাদী শক্তি, প্রশাসনের ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উদাসীনতা একসাথে দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য হুমকি। রাষ্ট্রকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, কারণ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করা গণতন্ত্রের অঙ্গ, আর এটাই দেশের ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।
রাষ্ট্র যদি এখনই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে ইতিহাস একদিন লিখে রাখবে— সংখ্যালঘুরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাইছিল, আর সরকার বিবৃতি দিচ্ছিল।
লিখেছেনঃ Md. Emdadul Hoque Chowdhury
মানবাধিকার কর্মী ও লেখক











