বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে নতুন মাশুল কার্যকর হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত এই মাশুল বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গতকাল রোববার (রাত ১২টা অতিক্রান্ত হওয়ার কিছু পর)। এতে আজ সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) থেকে বন্দরের সব ধরনের সেবায় নতুন মাশুল কার্যকর হলো।
সরকারি প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গড়ে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে কনটেইনার পরিবহনে, যা দেশের আমদানি-রপ্তানির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। এখন থেকে প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনারে গড়ে ৪,৩৯৫ টাকা অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হবে।
বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তি উপেক্ষিত
এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৪ জুলাই বন্দর মাশুলবৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল। এ নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত সেই আপত্তি গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুলে বড় ধরনের বৃদ্ধি বহাল থাকল।
ব্যবহারকারীদের আশঙ্কা, হঠাৎ প্রায় অর্ধেক বাড়তি মাশুল শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর চাপ তৈরি করবে, বিশেষ করে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা কমবে। তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের প্রধান রপ্তানি নির্ভর শিল্প, এতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে বলে মনে করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি এবং বিজিএমইএ পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন,
“কাঁচামাল যখন কনটেইনারে দেশে আসে তখন এক দফা মাশুল দিতে হয়। আবার একই কনটেইনারে তৈরি পোশাক রপ্তানির সময় দিতে হবে আরেক দফা। অর্থাৎ একই পণ্যে দুইবার বাড়তি খরচ পড়ছে—এটি কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।”
সরকারের যুক্তি
সরকার বলছে, প্রায় চার দশক পর বন্দর মাশুল বাড়ানো হলো এবং এখনও এটি প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে কম। তবে ব্যবসায়ী মহল মনে করছে, আগামীতে যখন বন্দরের বেশিরভাগ টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরদের নিয়ন্ত্রণে যাবে, তখন এই মাশুল বৃদ্ধির সুফল মূলত তারা পাবে।
কোথায় কতখানি বেড়েছে
- বর্তমানে ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য গড়ে ১১,৮৪৯ টাকা মাশুল দিতে হতো।
- নতুন হার অনুযায়ী একেক কনটেইনারে ১৬,২৪৩ টাকা দিতে হবে।
- অর্থাৎ গড়ে প্রতি কনটেইনারে বাড়তি ৪,৩৯৫ টাকা গুনতে হবে।
প্রতিকূল প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে কনটেইনার জাহাজ পরিবহনে।
- প্রতিটি কনটেইনার ওঠানো বা নামানোর মাশুল ছিল ৪৩.৪০ ডলার।
- এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ ডলার, অর্থাৎ এক লাফে প্রায় ২৫ ডলার বৃদ্ধি (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩,০০০ টাকা)।
এ ছাড়া—
- আমদানি কনটেইনারে গড়ে মাশুল ৫,৭২০ টাকা বেড়েছে।
- রপ্তানি কনটেইনারে বেড়েছে গড়ে ৩,০৪৫ টাকা।
বন্দরে সব ধরনের পণ্যের গড় হিসাব ধরলে, প্রতি কেজিতে ৩৫ পয়সার পরিবর্তে এখন ৪৯ পয়সা মাশুল দিতে হবে, অর্থাৎ প্রায় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি।
আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং এর প্রায় সবকটিই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যায়। শিল্পের কাঁচামাল হোক বা মূল্যবান যন্ত্রপাতি—সবই কনটেইনারে পরিবাহিত হয়। ফলে নতুন সিদ্ধান্তের ফলে কনটেইনারভিত্তিক ব্যবসাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে।
অন্যদিকে, বাল্ক কার্গো বা সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরের সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহার করে। তবে নতুন হারে এই পণ্যের ক্ষেত্রেও গড়ে কেজিপ্রতি মাশুল বাড়বে ১৪ পয়সা। উল্লেখযোগ্য বিষয়, বন্দরের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খালাস হওয়া মোট পণ্যের ৫৯ শতাংশই হয়েছে বন্দরের বহির্নোঙরে, যা তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়বহুল।
চট্টগ্রাম বন্দরে হঠাৎ এ মাশুল বৃদ্ধি বন্দর ব্যবহারকারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য এক নতুন ধাক্কা হয়ে এসেছে। তাঁদের দাবি, এটি রপ্তানি খাতকে প্রতিযোগিতাহীন করবে। বিপরীতে, সরকারের দাবি—দেশের আঞ্চলিক বাজারের সঙ্গে তুলনা করলে এই খরচ এখনও অনেক কম।
তাই মূল প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই বাড়তি চাপ শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলবে, আর রপ্তানি খাত তা কতটা সহ্য করতে পারবে।











