বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 8:26 pm
October 29, 2025 8:26 pm

আয়রন-ঘটিত রক্তাল্পতা: লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

আয়রন–ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া বা আয়রন-ঘটিত রক্তাল্পতা হলো বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত রক্তজনিত সমস্যা, যা সরাসরি লোহিত রক্তকণিকা বা রেড ব্লাড সেলকে প্রভাবিত করে। এটি মূলত রক্তে পর্যাপ্ত আয়রনের ঘাটতি থেকে তৈরি হয়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সময়ে ধরা পড়লে ও চিকিৎসা শুরু হলে এর চিকিৎসা সফল হয়, তবে উপেক্ষা করলে মারাত্মক জটিলতায় গড়াতে পারে।

আয়রন-ঘটিত রক্তাল্পতা কীভাবে হয়?

হিমোগ্লোবিন হলো লোহিত রক্তকণিকার প্রধান উপাদান, যা শরীরে অক্সিজেন বহন করে। পর্যাপ্ত আয়রন না থাকলে অস্থিমজ্জা পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না। এর ফলে রক্তে অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়।

এ অবস্থায় রোগীরা সাধারণত ক্লান্তি, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট ও দ্রুত হৃদস্পন্দন অনুভব করেন। অনেকে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, হাত–পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিকভাবে বরফ, কাগজ বা মাটি খাওয়ার প্রবণতা (পিকা) টের পান।

পর্যায়ভেদে রোগের গতি

আয়রন-ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া ধীরে ধীরে তৈরি হয় এবং তিনটি ধাপে ভাগ করা যায়:

  1. প্রথম ধাপ: শরীরের আয়রন ভাণ্ডার বা স্টোরেজ কমতে শুরু করে। এখনো রক্তকণিকা প্রভাবিত হয় না।
  2. দ্বিতীয় ধাপ: আয়রনের ঘাটতি বাড়লে অস্থিমজ্জা পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন ছাড়া রক্তকণিকা তৈরি করে।
  3. তৃতীয় ধাপ: রক্তে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক মাত্রার নিচে নেমে আসে। তখনই প্রকটভাবে রক্তাল্পতার লক্ষণ দেখা দেয়।

প্রধান লক্ষণ

  • অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা
  • শ্বাসকষ্ট
  • মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা
  • ফ্যাকাশে ত্বক
  • কোঁচকানো বা চামচের মতো নখ (Koilonychia)
  • অস্থিরতা, বিরক্তি ও মনোসংযোগে সমস্যা
  • জিহ্বা লাল বা ব্যথাযুক্ত হওয়া
  • ‘পিকা’ সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া (খাদ্যবহির্ভূত জিনিস খেতে ইচ্ছে হওয়া)

এর কারণ কী?

  • অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ: বিশেষ করে নারীদের অতিরিক্ত মাসিক স্রাব বা গ্যাস্ট্রিক আলসার, ক্রনস ডিজিজ বা আলসারেটিভ কোলাইটিসের মতো রোগে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ।
  • আয়রনের শোষণ ব্যাহত হওয়া: সিলিয়াক রোগ বা ওজন কমানোর সার্জারির মতো অবস্থা।
  • খাদ্যাভ্যাসে ঘাটতি: যথেষ্ট আয়রনসমৃদ্ধ খাবার না খাওয়া।

ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী

  • গর্ভবতী ও সদ্য সন্তান জন্ম দেয়া নারী
  • স্তন্যদায়ী মায়েরা
  • নিয়মিত রক্তদাতা
  • ভারী মাসিক যাতায়াত থাকা নারী
  • যাদের হিস্ট্রি আছে বড় ধরনের শল্যচিকিৎসার (বিশেষত পরিপাকতন্ত্রের)

কী ধরনের জটিলতা হতে পারে?

যদি এটি দীর্ঘ সময় চিকিৎসাহীন থাকে, তবে বাড়তে পারে—

  • শিশুদের বৃদ্ধিজনিত সমস্যা
  • হৃদযন্ত্রের সমস্যা (হার্ট বড় হয়ে যাওয়া বা হার্ট ফেইলিওর)
  • মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত
  • রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম

নির্ণয়

রক্তপরীক্ষার মাধ্যমেই আয়রন-ঘটিত রক্তাল্পতার নিশ্চিত নির্ণয় হয়। এতে সাধারণত দেখা হয়—

  • আয়রনের মাত্রা
  • ফেরিটিন (শরীরে আয়রন সঞ্চয় মাপার সূচক)
  • টোটাল আইরন বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি (TIBC)

প্রয়োজনে চিকিৎসক রোগ অনুযায়ী অন্যান্য পরীক্ষাও করতে পারেন।

চিকিৎসা

চিকিৎসা নির্ভর করে রোগীর আয়রনের ঘাটতির মাত্রা ও কারণের ওপর। প্রচলিত চিকিৎসা হলো—

  • মুখে খাওয়ার আয়রন সাপ্লিমেন্ট: ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে।
  • আয়রন ইনফিউশন: যাদের গুরুতর ঘাটতি আছে, শিরার মাধ্যমে সরাসরি আয়রন দেওয়া হয়।

একইসঙ্গে চিকিৎসক মূল কারণ (যেমন—রক্তক্ষরণ, গ্যাস্ট্রিক আলসার) খুঁজে বের করে তা নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করেন।

চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

অনেক সময় আয়রন সাপ্লিমেন্টে দেখা দিতে পারে—

  • মুখে ধাতব স্বাদ
  • কোষ্ঠকাঠিন্য
  • ডায়রিয়া
  • বমি বমি ভাব বা বমি
  • কালো রঙের মল

ডোজ পরিবর্তন বা ভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

কত দিনে ফল পাওয়া যায়?

  • মুখে খাওয়ার আয়রনের ক্ষেত্রে ২–৩ সপ্তাহের মধ্যে উন্নতি দেখা যায়।
  • ইনফিউশনের ক্ষেত্রে তুলনামূলক দ্রুত ফল পাওয়া যায়।

প্রতিরোধ ও জীবনযাপন

যথাসময়ে পরীক্ষা করলে ও আয়রন গ্রহণ নিশ্চিত করলে সাধারণত রোগ প্রতিরোধযোগ্য।

আয়রনসমৃদ্ধ খাবার:

  • লাল মাংস ও লিভার
  • মুরগি, মাছ ও ডিম
  • পালং শাক, ব্রকলি, বিট ও অন্যান্য সবুজ শাক
  • ডাল, ছোলা, টোফু
  • ডুমুর, খেজুর ও কিসমিস

শাকাহারীদের জন্য টিপস: আয়রন-সমৃদ্ধ সিরিয়াল, ফোর্টিফায়েড ব্রেড, টোফু, গাঢ় সবুজ শাক এবং শুকনো ফল। প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট।

চিকিৎসকের কাছে কখন যাবেন?

  • যদি বারবার ক্লান্ত বোধ করেন
  • শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা বা দ্রুত হার্টবিট হয়
  • অস্বাভাবিকভাবে ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যায়
  • অতিরিক্ত মাসিক স্রাব বা হজমজনিত রক্তক্ষরণ থাকে

তখন অবশ্যই রক্তপরীক্ষা প্রয়োজন। চিকিৎসক পরিস্থিতিভেদে গাইনোকোলজিস্ট বা গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের কাছে রেফার করতে পারেন।

আয়রন-ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া একদিকে খুবই সাধারণ, আবার চিকিৎসাহীনভাবে অবহেলায় রাখলে মারাত্মক জটিলতায় রূপ নিতে পারে। সময়মতো শনাক্তকরণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, আয়রন সাপ্লিমেন্ট বা ইনফিউশনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আয়রনের ঘাটতির মূল কারণ খুঁজে বের করে চিকিৎসা করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *