বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 10:56 pm
October 29, 2025 10:56 pm

শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই চড়া চালের বাজার, ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

বাংলাদেশে চালের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্রই বেড়েছে চালের দাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশ্বিন মাস সামনে থাকায় কর্মসংকট ও বাজার-নিয়ন্ত্রিত সংকট—দুটোই ভূমিকা রাখছে এতে। যদিও এ বছর বোরো মৌসুমে ভালো উৎপাদন হয়েছে এবং আমদানির পথও খোলা রয়েছে, তবু দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

দীর্ঘদিন ধরেই উর্ধ্বমুখী দাম

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য মতে, প্রায় তিন মাস ধরেই চালের দাম তুলনামূলকভাবে চড়া। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় খুচরা বাজারে গত এক থেকে দেড় মাসে কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একই অবস্থা ধান উৎপাদন এলাকা নওগাঁ, রংপুর ও কুষ্টিয়াতেও।

ঢাকার বাজারে দাম (বৃহস্পতিবারের তথ্য):

  • সরু চাল (মিনিকেট, নাজিরশাইল): কেজি ৭৩ থেকে ৮৫ টাকা
  • মাঝারি চাল (বিআর-২৮, পাইজাম): কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা
  • মোটা চাল (গুটি স্বর্ণা, চায়না ইরি): কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকা

টিসিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সরু চালের দাম বেড়েছে ১১.১১%, মাঝারি চালের দাম ১৭.৩৯% এবং মোটা চালের দাম ৭.৪৮%

বাজার নিয়ন্ত্রণে করপোরেট ও বড় মিলাররা?

খুচরা ব্যবসায়ী ও ছোট চালকল মালিকরা অভিযোগ করছেন, করপোরেট গ্রুপ এবং শীর্ষ অটো রাইস মিল মালিকরা কম সুদের ঋণ নিয়ে আগেভাগেই বিপুল পরিমাণ ধান কিনে মজুত করেন। পরে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ান। এর ফলে ভোক্তা, কৃষক এবং ক্ষুদ্র মিল মালিক—তিন পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, লাভবান হচ্ছে কেবল বড় করপোরেট গ্রুপগুলো।

নওগাঁ অটো রাইস মিল সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌফিকুল ইসলাম বাবু বলেন,

“কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না, আর ভোক্তাকে চড়া দামে চাল কিনতে হচ্ছে। বাজার এখন পুরোপুরি করপোরেটদের দখলে।”

একই অভিযোগ করেছেন নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার। তাঁর ভাষ্য, ক্ষুদ্র মিল মালিকরা ১৩-১৪% সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হলেও করপোরেট গ্রুপগুলো ৩-৪% সুদে ঋণ পেয়ে সহজেই বিপুল পরিমাণ ধান-চাল মজুত করতে পারছে।

কুষ্টিয়ায় সিন্ডিকেটের বাজার নিয়ন্ত্রণ

কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে ১০ জন অটো মিল মালিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা একসঙ্গে ধান মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন, তারপর বাড়তি দামে চাল বিক্রি করেন। স্থানীয় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং খাদ্য বিভাগও তাদের কারসাজির তথ্য নিশ্চিত করেছে।

খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা আল ওয়াজিউর রহমান বলেন,

“কোনো মিলার অতিরিক্ত ধান মজুত করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রমাণ মিললে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

রংপুরেও একই চিত্র

রংপুরে সম্প্রতি চালের বাজারে ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। খুচরায় কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৭ টাকা। রংপুর জেলা রাইস মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন,

“ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষক বিক্রি করতে বাধ্য হন। বড় মিলাররা এই সুযোগ নিয়ে কম দামে কিনে মজুত করেন এবং পরে বেশি দামে বিক্রি করেন।”

স্থানীয় কৃষক আলেফ উদ্দিন জানান,

“ধান সেদ্ধ, শুকানো কিংবা সংরক্ষণের খরচ বহন করা সম্ভব নয়। তাই কাটার পর পরই বিক্রি করি। পরে বেশি দামে চাল কিনতে গিয়ে আমাদেরই ভোগান্তি হয়।”

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে মূল কারণ

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, অতি মুনাফার লোভ, করপোরেট নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের পর্যাপ্ত বাজার হস্তক্ষেপ না থাকা—এই তিন কারণে মূলত চালের বাজার অস্থির থাকে। তাঁর মতে,

“কৃষকের ধান একবার করপোরেটদের হাতে চলে গেলে তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সরকার যদি পর্যাপ্ত চাল খোলাবাজারে বিক্রি করতে পারত, দাম নিয়ন্ত্রণে আসত।”

ক্যাবের সভাপতি এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন,

“কত বাড়তি মুনাফা সিন্ডিকেটের পকেটে যাচ্ছে, তা নিরূপণ করা উচিত। আমরা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করব।”

সরকারের অবস্থান

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সরকার বর্তমানে ১৯.৫ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রেখেছে—এর মধ্যে ১৮.৩৩ লাখ টন চাল, ১.২৮ লাখ টন ধান এবং ০.৯৮ লাখ টন গম রয়েছে। এ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতোমধ্যে প্রায় ৬ লাখ টন চাল ও গম আমদানি করা হয়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে করপোরেট ও বড় মিল মালিকদের হাতে মজুত থাকে ১০-১৫ মিলিয়ন টন, যা বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে।

দেশে উদ্বৃত্ত চাল উৎপাদন, আমদানির সুযোগ ও সরকারি মজুত থাকা সত্ত্বেও দাম অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এর প্রধান কারণ হিসেবে ছোট ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও বিশ্লেষকরা এককথায় বলছেন—করপোরেট কোম্পানি ও বড় মিল মালিকদের সিন্ডিকেট। খাদ্যশস্য নীতিতে সরকারের আরও কার্যকর পদক্ষেপ ও বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধির দাবি উঠছে সর্বত্র।

শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন রয়ে যায়—কৃষক ও ভোক্তাকে বাঁচাতে সরকার কতটা কড়া মনোভাব নিতে প্রস্তুত, নাকি করপোরেটের আধিপত্যেই চলবে দেশের চালের বাজার?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *