আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নজিরবিহীন এক ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপের বলকান অঞ্চলের দেশ আলবেনিয়া। প্রধানমন্ত্রী এডি রামা জানিয়েছেন, তাঁর সরকার দুর্নীতি দমনে নিয়োগ দিয়েছে একজন নতুন মন্ত্রীকে। তবে তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ নন, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তিনির্ভর ভার্চুয়াল মন্ত্রী। নাম দেওয়া হয়েছে — ‘ডিয়েলা’, যার অর্থ আলবেনীয় ভাষায় ‘সূর্য’।
এই প্রথম কোনো দেশ প্রতীকী নয়, আনুষ্ঠানিকভাবে এআই প্রযুক্তিকে মন্ত্রী পর্যায়ে নিয়োগ করায় বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে—এটা কি সত্যিই দুর্নীতির অন্ধকারে এক ‘সূর্যোদয়’, নাকি কেবল প্রযুক্তি কূটনীতি ও প্রতীকী প্রদর্শন?
আলবেনিয়ার দুর্নীতি সংকট
আলবেনিয়া বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (EU) যোগদানের প্রচেষ্টায় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এডি রামার নেতৃত্বে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়েছে সমাজতান্ত্রিক পার্টি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশটিকে ইইউ–অভ্যর্থনার জন্য উপযোগী করবেন।
কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর দুর্নীতি সূচকে আলবেনিয়ার অবস্থান খুবই হতাশাজনক।
- ২০২৪ সালে দেশটির অবস্থান ছিল ৮০তম।
- পশ্চিম বলকান অঞ্চলে ঘুষ লেনদেনে শীর্ষে আলবেনিয়া।
- এক জরিপে বলা হয়েছে, ৪০% নাগরিক দুর্নীতির অভিজ্ঞতা পেয়েছেন এবং ৫২% জন সরকারি কাজের ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
- প্রায় ২৭ লাখ মোট জনসংখ্যার ৮০% মানুষই ২০২৩-২৪ সালে ঘুষ দেওয়ার বা নেওয়ার প্রলোভন বা চাপের মুখে পড়েছেন।
ইইউ সদস্যপদ অর্জনের বড় অন্তরায় ঠিক এই দুর্নীতি সংকট।
এআই মন্ত্রী ‘ডিয়েলা’ কীভাবে কাজ করবে?
প্রধানমন্ত্রী রামা জানিয়েছেন, দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি হয় সরকারি ক্রয় বা পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট খাতে। সুতরাং প্রথমেই এ খাতে এআই মন্ত্রীর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে।
ডিয়েলা এরই মধ্যে সরকারি ই-সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম “ই-আলবেনিয়া”-র সঙ্গে সংযুক্ত।
- সরকারি সব দরপত্র (tenders) ডিয়েলার অ্যালগরিদমে আপলোড করা হবে।
- মেশিন লার্নিং ও ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এটি দরদাতা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা, পূর্বের কর্মতথ্য স্ক্যান করবে।
- আন্তর্জাতিক (যেমন ইইউর ক্রয়বিধি) এবং আলবেনিয়ার দুর্নীতি-বিরোধী আইন অনুযায়ী বৈষম্য বা অস্বাভাবিক বিড শনাক্ত করবে।
- সন্দেহজনক কোনো কোম্পানি থাকলে তাদের নামের পাশে সতর্কবার্তা দেবে সিস্টেম।
সাধারণত এ ধরনের দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করতে ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ সময় লাগে। কিন্তু ডিয়েলার মাধ্যমে এটি মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
চলতি মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিয়েলা দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে অন্তত ১০০টি দরপত্র নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সুবিধা: স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত ও সময় সাশ্রয়
ডিয়েলা মানবীয় পক্ষপাত, ঘুষ, লবিং এবং রাজনৈতিক চাপ এড়াতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
- সিদ্ধান্ত হবে স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য।
- সময়, খরচ এবং প্রশাসনিক জটিলতা কমবে।
- সরকারি ভাতা, ভর্তুকি বা নাগরিক সেবা সরাসরি জনগণের কাছে পৌঁছাবে।
বিতর্ক: সাংবিধানিক প্রশ্ন ও প্রযুক্তিগত দায়
তবে এই উদ্যোগকে ঘিরে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে বিরোধিতা ও বিতর্ক।
- আলবেনিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা হলো মানসিক সক্ষমতা ও সচেতনতা। বিরোধী ‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ বলছে, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো মানসিক সক্ষমতা নেই, সুতরাং মন্ত্রী হিসেবে ডিয়েলার নিয়োগ সাংবিধানিকভাবে বৈধ নয়।”
- আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
- এআই মোটেও শতভাগ নির্ভুল নয়। অ্যালগরিদমে পক্ষপাত থাকতে পারে এবং মূল প্রোগ্রামিংয়ে যারা যুক্ত থাকবেন, তাদের রাজনৈতিক বা কর্পোরেট স্বার্থ ঢুকে যেতে পারে।
- হ্যাকিং বা সাইবার হামলার মাধ্যমেও জনবল বাছাই ও দরদাতা নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত হতে পারে।
- চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এখনো মানুষের ভূমিকা থাকবে, ফলে সেই পর্যায়ে আবার দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
- সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা: সরকারি ক্রয়খাতের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য কর্মচারীর দায়িত্ব কী হবে? চাকরি হারানো বা ভূমিকা সংকোচনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিশ্বে প্রভাব ও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য দৃষ্টান্ত
ডিয়েলার পরীক্ষামূলক উদ্যোগ সফল হলে এটি হয়ে উঠতে পারে এআই গভর্নেন্সে বৈশ্বিক মাইলফলক। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো—যেখানে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অনিয়ম অর্থনৈতিক অগ্রগতির বড় অন্তরায়—তাদের জন্য এটি হতে পারে অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।
আলবেনিয়া ঘোষণা দিয়েছে, ডিয়েলা যদি প্রাথমিক ধাপে অন্তত ৮০% কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে ২০২৬ সালের মধ্যে এর পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগে যাবে সরকার।
জনমতের প্রতিক্রিয়া
আল জাজিরার প্রতিবেদনে উদ্ধৃত হয়েছে কয়েকজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রতিক্রিয়া।
একজন লিখেছেন—
“চুরি চলতেই থাকবে। এখন শুধু দোষ চাপানো হবে এআইয়ের ওপর।”
আলবেনিয়ার এ ‘এআই মন্ত্রী’ নিয়োগ একদিকে যেমন আধুনিক প্রযুক্তিকে প্রশাসনে যুক্ত করার সাহসী পদক্ষেপ, অন্যদিকে সাংবিধানিক ও প্রযুক্তিগত দায় নিয়ে প্রশ্নও তুলছে। ডিয়েলা যদি লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, তবে এটি শুধু আলবেনিয়ার জন্য নয়, সারা বিশ্বের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।











