বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 8:26 pm
October 29, 2025 8:26 pm

বাংলাদেশে সমলিঙ্গ প্রেমিকদের অধিকার: এক অস্বীকৃত বাস্তবতা

মানবাধিকার কথাটি আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—মানবাধিকার কি শুধুই সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য? যারা সমাজের মূলস্রোতের বাইরে, তাদের জন্য কি মানবাধিকারের কোনো স্থান নেই? বাংলাদেশে সমলিঙ্গ প্রেম, বা হোমোসেক্সুয়াল সম্পর্ক, এখনো এক অস্বীকৃত বাস্তবতা। এই বাস্তবতা সমাজ, আইন এবং রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যেন অদৃশ্য করে রাখা হয়েছে। অথচ যারা এই যৌন প্রবণতা বা পরিচয়ে জীবন যাপন করেন, তাদের জন্য প্রতিদিনের জীবন এক সংগ্রাম, এক ভয়ের নাম।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি

বাংলাদেশি সমাজে যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা এখনো নিষিদ্ধের মতো। সেখানে সমলিঙ্গ প্রেম বা সমকামী সম্পর্ক তো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলে ধরা হয়। অধিকাংশ মানুষ এটিকে “পাপ” বা “বিকৃতি” হিসেবে দেখে। এর ফলে সমকামী মানুষরা সামাজিকভাবে উপহাস, বৈষম্য এবং হুমকির শিকার হন। অনেকে বাধ্য হন দ্বৈত জীবন যাপন করতে। প্রকাশ্যে তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনুরাগ দেখান, কিন্তু অন্তরে লুকিয়ে রাখেন তাদের প্রকৃত সত্তা।

আইনি অবস্থান

বাংলাদেশে এখনো দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা কার্যকর রয়েছে, যেখানে “অপ্রাকৃতিক যৌন সম্পর্ক”কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই আইনের শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড। বাস্তবে এই আইন কতটা প্রয়োগ হয়, তা বিতর্কের বিষয়, তবে এই আইনের অস্তিত্বই হোমোসেক্সুয়াল মানুষদের জন্য এক ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধকতা। কারণ, কোনো সময় তাদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করে হয়রানি করা সম্ভব।

আন্তর্জাতিকভাবে এখন ৭০টিরও বেশি দেশে সমলিঙ্গ প্রেম বৈধ, বহু দেশে সমলিঙ্গ বিবাহও স্বীকৃত। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে এখনো এই বিষয়ে কঠোর আইন বিদ্যমান। ভারত ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩৭৭ ধারা বাতিল করে সমকামী সম্পর্ক বৈধ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এখনো সেই পথে হাঁটেনি। ফলে বাংলাদেশের সমকামী জনগোষ্ঠী আইনগত দিক থেকেও অবহেলিত।

মানবাধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নীতি

জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বারবার বলেছে—যৌন প্রবণতা বা যৌন পরিচয় মানবাধিকারের বিষয়। মানুষ জন্মগতভাবে সমকামী হতে পারে, এটা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন আইন করে এই পরিচয়কে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে রাখে, তখন সেই রাষ্ট্র আসলে মানবাধিকারকে অস্বীকার করছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রায়ই মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতির কথা বলে, আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সইও করেছে। কিন্তু বাস্তবে সমকামী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেই প্রতিশ্রুতি কোথায়? তারা কি এই দেশের নাগরিক নয়? তারা কি কর দেয় না? তারা কি সমাজে অবদান রাখে না? তাহলে কেন তাদের মৌলিক মানবাধিকার—ভালোবাসার অধিকার, বেছে নেওয়ার অধিকার, স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার—অস্বীকৃত?

দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম

হোমোসেক্সুয়াল বা সমকামী মানুষরা প্রতিদিন ভয়ের মধ্যে থাকেন। কেউ যদি তাদের প্রকৃত পরিচয় জেনে ফেলে, তবে চাকরি থেকে বহিষ্কার, পরিবার থেকে বিতাড়ন, সমাজে লাঞ্ছনা—সবই হতে পারে। অনেকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেন বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে, যার ফলে ভেঙে যায় অনেক সংসার, নষ্ট হয় অনেক মানুষের জীবন।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এই দ্বৈত জীবন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ। আত্মহত্যার প্রবণতা, বিষণ্নতা, উদ্বেগ—এসব মানসিক রোগ সমকামী মানুষদের মধ্যে অনেক বেশি। অথচ সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের কোনো সহযোগিতা করে না।

আশার আলো

বাংলাদেশে এখনো খুব সীমিত হলেও কিছু সংগঠন আছে যারা এলজিবিটি সম্প্রদায়ের (LGBTQ+) অধিকার নিয়ে কাজ করছে। তারা জনসচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করছে, বৈষম্য দূর করতে চাইছে। তবে তাদের পথ সহজ নয়। অনেক সময় তাদের মিটিং ভেঙে দেওয়া হয়, কর্মীদের হুমকি দেওয়া হয়। তবু ধীরে ধীরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কিছুটা সহনশীলতা বাড়ছে।

ভবিষ্যতের পথ

মানবাধিকার মানে সবার অধিকার—শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়। বাংলাদেশ যদি সত্যিই আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে চায়, তবে সমলিঙ্গ প্রেম ও যৌন বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। ৩৭৭ ধারা বাতিল করতে হবে, আইনগত সুরক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি গণমাধ্যম, শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতায় এই বিষয়গুলো খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে।

শুধু আইনের সংস্কার নয়—সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইন হয়তো আগামীকাল পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু সমাজ যদি না বদলায় তবে সমকামী মানুষরা নিরাপদে বাঁচতে পারবেন না।

উপসংহার

বাংলাদেশের সমকামী মানুষরা আজো অন্ধকারে বসবাস করছেন। তাদের প্রতি সমাজের ঘৃণা, আইনের শঙ্কা ও রাষ্ট্রের নীরবতা—সব মিলিয়ে তারা যেন অদৃশ্য নাগরিক। অথচ তারা কারো থেকে আলাদা নন—তাদেরও স্বপ্ন আছে, ভালোবাসা আছে, মানবিক মর্যাদা আছে।
মানবাধিকার মানে যদি হয় সবার সমান অধিকার, তবে সমলিঙ্গ প্রেমিকদের অধিকার অস্বীকার করা মানে মানবাধিকারের মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *