বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 9:59 am
October 29, 2025 9:59 am

রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির ভয়াবহ নীরবতা

Md. Emdadul Hoque Chowdhury

এই মরণব্যাধির সমাধান কি শুধুই আইন কাগজে?

বাংলাদেশে শিশুর নিরাপত্তা আজ এক মিথ্যে প্রতিশ্রুতি। আইন আছে, সংবিধান আছে—কিন্তু শিশুর জীবনের নিশ্চয়তা নেই। ২০২৫ সালেও যখন ধর্ষণের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়, তখন প্রশ্ন জাগে—এই রাষ্ট্রের বিবেক কোথায়?

বাংলাদেশে শিশু ও কন্যাশিশুর ওপর যৌন সহিংসতা আজ এমন এক দৈনন্দিন আতঙ্ক, যা কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা নয়—এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ২০২৫ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র আট মাসে ৩৯০টি কন্যাশিশু ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, ২৯ জন প্রতিবন্ধী শিশু, ১৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৫ জন আত্মহত্যা করেছে। একই সময়ে ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে এ সংখ্যা ছিল ২২৪। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের হার প্রায় দ্বিগুণ।

এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়—আইন আছে, আন্দোলন আছে, কিন্তু বাস্তবে বিচার নেই।

এক তেরো বছরের মাদ্রাসাছাত্রী, তিন দিনের দুঃস্বপ্ন

সাম্প্রতিক এক ঘটনায় দেশের বিবেক কেঁপে উঠেছে। রাজধানীর উপকণ্ঠে একটি মাদ্রাসা-পড়ুয়া ১৩ বছরের শিশুকে এক হিন্দু কিশোর অপহরণ করে তিন দিন ধরে ধর্ষণের পর হত্যা করে। পরিবার থানায় গেলে প্রথমে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে; পরে স্থানীয় চাপের মুখে মামলা হয়। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে, অপরাধী কোনো ধর্ম, বর্ণ বা গোষ্ঠীর নয়—অপরাধীর ধর্ম একটাই: নৃশংসতা। এ ঘটনা আবারও প্রমাণ করেছে, শিশুরা মাদ্রাসায় নিরাপদ নয়, স্কুলে নয়, এমনকি ঘরেও নয়। যেখানে শিশুরা শেখার কথা ভালোবাসা ও মানবতা, সেখানে তারা পাচ্ছে লাশ হয়ে ফেরার যন্ত্রণা।

পরিবার পরিচিতজনই এখন ভয়

Ain o Salish Kendra (ASK)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সংঘটিত ধর্ষণ মামলার প্রায় ৫৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ছিল ভুক্তভোগীর পরিচিত বা আত্মীয়।

অর্থাৎ, শিশুর সবচেয়ে কাছের মানুষই তার সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠছে।

একজন মা বলেন,“আমি মেয়েকে ধর্ম শেখাতে পাঠিয়েছিলাম, এখন প্রতিদিন তার কবরের পাশে বসে কাঁদি।”এ যেন এক সমাজের মৃত্যু—যেখানে মা-বাবাও সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন না।

 

বিচারহীনতার সংস্কৃতি: অপরাধীর সাহস, ভুক্তভোগীর মৃত্যু

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থাকলেও, বাস্তবতায় তার কার্যকারিতা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, ধর্ষণ মামলার রায় হয় মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশে। বাকি সব মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, অথবা রাজনৈতিক প্রভাবশালী আসামিরা পার পেয়ে যায়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে বলেছেন—“বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি এখন অপরাধীদের রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।”

এই বিচারহীনতাই অপরাধীদের সাহস জোগায়, আর ভুক্তভোগীর পরিবারকে ঠেলে দেয় আত্মহননের দিকে। ধর্ষকেরা বুক ফুলিয়ে হেঁটে চলে, কিন্তু ধর্ষিতা প্রতিদিন মরে—এটাই আজকের বাংলাদেশের চিত্র।

 

রাজনীতি প্রশাসনের দ্বিমুখিতা

দুঃখজনক হলেও সত্য, ধর্ষণের দায় কেবল সমাজের নয়—রাজনীতিরও আছে।

নোয়াখালী, সিলেট, টাঙ্গাইল—সব জায়গায় দেখা গেছে, ধর্ষণের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের নাম এসেছে। কিন্তু দুই দলই একে অন্যকে দায় দিয়ে দায় এড়িয়ে যায়। যে দলে অপরাধীর আশ্রয় আছে, সেই দল কীভাবে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলে? রাজনীতির এই দ্বিমুখিতা আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিকতারও পতন ঘটিয়েছে। ক্ষমতা রক্ষাই যখন উদ্দেশ্য, তখন শিশুর নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পায় না।

 

প্রশাসনের ভূমিকা: নীরবতা, গাফিলতি, অমানবিকতা

অধিকাংশ ধর্ষণ মামলায় দেখা যায়—পুলিশ মামলা নিতে চায় না, তদন্তে দেরি করে, অথবা “সমঝোতা” করতে চাপ দেয়। একজন শিশুর মা অভিযোগ করেছেন, “মেয়েকে হারিয়ে থানায় গিয়েছিলাম, পুলিশ বলল—প্রেমের ব্যাপারও হতে পারে।”এই উদাসীনতা শুধু অমানবিক নয়; এটি প্রশাসনিক অপরাধ।

 

জাতিসংঘের বাংলাদেশ কার্যালয় ২০২৫ সালে বলেছে

“বাংলাদেশে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা রক্ষায় প্রশাসনের জবাবদিহি ও তদন্তব্যবস্থা দুর্বল। সংস্কার ছাড়া এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।”

নারী শিশুবাদী সংগঠন: কণ্ঠ আছে, কিন্তু কর্ম নেই

দেশে Naripokkho, BRAC, ASK, Bangladesh Mohila Parishad—এই সংগঠনগুলো শিশু নির্যাতন রোধে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অধিকাংশ সময় তাদের কার্যক্রম সেমিনার, প্রতিবেদন ও প্রেস ব্রিফিংয়ে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণ বা প্রান্তিক পর্যায়ে, যেখানে অধিকাংশ নির্যাতন ঘটে, সেখানে এই সংগঠনগুলোর উপস্থিতি অতি নগণ্য। তাদের আরও মাঠনির্ভর ও কার্যকর হতে হবে, কারণ শিশুর জীবনের প্রশ্নে এখন প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ প্রয়োজন।

 

পুরুষতন্ত্র: এই সামাজিক ব্যাধির মূল শিকড়

বাংলাদেশে মেয়েদের শৈশব থেকেই শেখানো হয়—“চুপ থাকাই শোভনতা।”এই চুপ থাকার সংস্কৃতিই পুরুষতন্ত্রকে লালন করে। যেখানে নারীকে ‘অধস্তন’ ভাবা হয়, সেখানে ধর্ষণ কেবল অপরাধ নয়—একটি মানসিক আধিপত্যের প্রকাশ। যতক্ষণ না পরিবারে, স্কুলে ও ধর্মীয় বয়ানে লিঙ্গসমতা শেখানো হয়, ততক্ষণ এই সমাজে শিশুর নিরাপত্তা কাগজেই থেকে যাবে।

সমাধানের পথ: মানবিক বিপ্লব ছাড়া বিকল্প নেই

  • দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল: শিশু ধর্ষণ মামলার রায় ছয় মাসের মধ্যে দিতে হবে।
  • পুলিশি সংস্কার: থানায় “ভিকটিম সাপোর্ট ডেস্ক” বাধ্যতামূলক করতে হবে।
  • শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার: স্কুল ও মাদ্রাসায় মানবাধিকার ও লিঙ্গসংবেদনশীল শিক্ষা চালু করতে হবে।
  • ডিজিটাল নিরাপত্তা: অনলাইন পর্নোগ্রাফি ও সাইবার হয়রানি নিয়ন্ত্রণে বাস্তব পদক্ষেপ জরুরি।
  • রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা: অপরাধী দলের হলেও যেন ছাড় না পায়।
  • মানসিক সহায়তা কেন্দ্র: প্রতিটি জেলায় ধর্ষণ-ভুক্তভোগীর মানসিক চিকিৎসা ও আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

 

শেষ কথা: রাষ্ট্রের বিবেক এখন কোথায়?

ধর্ষকেরা হাসে, ভুক্তভোগী কাঁদে। ধর্ষকের পরিবার সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে, কিন্তু ধর্ষিতার পরিবার আজীবন লজ্জার ভারে নুয়ে পড়ে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি—সবাই যদি নীরব থাকে, তবে এই নীরবতাই আগামী দিনের অপরাধের জন্ম দেবে।

আজ প্রশ্ন রেখে শেষ করতে চাই— আমরা কি এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে শিশুরা ভয় পেয়ে বাঁচবে? নাকি এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে প্রতিটি শিশু নিরাপদ আকাশের নিচে হাসবে?

উত্তর এখন আমাদেরই দিতে হবেবিবেক দিয়ে, দায়িত্ব নিয়ে, সাহস নিয়ে।

 

লিখেছেনঃ Md. Emdadul Hoque Chowdhury

মানবাধিকার কর্মী  লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *