বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 8:24 pm
October 29, 2025 8:24 pm

যখন রাষ্ট্র ১৮% মানুষকে নিষিদ্ধ করে, তখন গণতন্ত্র মরে যায়!

Md. Emdadul Hoque Chowdhury

গণতন্ত্র কি শুধু সংখ্যার খেলা?

গণতন্ত্রকে প্রায়শই কেবল নির্বাচনী ফলাফলের সংখ্যা গোনার নাম হিসেবে ভুল করা হয়। কিন্তু এর মূল ভিত্তি নিহিত থাকে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে। যদি রাষ্ট্র ঘোষণা করে—“এই দল আর রাজনীতি করতে পারবে না”—তাহলে কি আসলেই বলা হচ্ছে যে এই দলটি অবৈধ? নাকি বলা হচ্ছে যে এই দলের প্রতি আস্থা রাখা মানুষগুলো রাজনৈতিক নাগরিক হিসাবেই অযোগ্য? গণতন্ত্র কি শুধু নির্বাচনী ফলাফলের সংখ্যা গুনার নাম, নাকি এটি প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া?

অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই রকম ঘটেছে যখন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশের একটি বৃহৎ, ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করে তখন গণতন্ত্রের মরণ হয়। এখনো দেশের ১৮.৮% মানুষ এখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে চান, তাদেরকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত করা কেবল দল নয়, মানবিক অধিকারও হরণ। এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে: গণতন্ত্রের শিরদাঁড়াটি কি আজও টিকে আছে, নাকি শুধুই নামমাত্র?

সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি

রাজনৈতিক অধিকার হরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, কারণ তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় প্রকার আইনেই সুরক্ষিত। বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে:

– ধারা ৩৭: শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও সভা-সমিতি করার অধিকার

– ধারা ৩৮: রাজনৈতিক দল গঠন ও অংশগ্রহণের স্বাধীনতা

– ধারা ৩৯: মত প্রকাশের অধিকার

এই অধিকারসমূহ কেবল ব্যক্তিগত অপরাধের ক্ষেত্রেই সীমিত করা যেতে পারে, কোনো দল বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও একই কথা বলে। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICCPR)-এর Article 19, 21, 22, 25 অনুযায়ী—রাজনৈতিক মত প্রকাশ, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রতিটি মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার। দল নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই অধিকার হরণ করা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। দল বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়।

 

দমন-পীড়নের পরিসংখ্যান (২০২৪-২৫)

গ্রেফতার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১,২০০+ আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছেন।

 

মামলা: স্থানীয় প্রশাসনিক তথ্য অনুযায়ী, ৯০,০০০+ মামলা আ.লীগ সমর্থক বা নেতা-কর্মীদের নামে দায়ের হয়েছে।

হত্যার ঘটনা: জাতিসংঘ OHCHR অনুসারে, ২০২৪-২৫ এ অন্তত ৪৫ জন আওয়ামী লীগের সমর্থক নির্যাতন ও হামলায় নিহত হয়েছেন।

হামলার ঘটনা: স্থানীয় সংবাদমাধ্যম অনুসারে, ৩০০+ হামলার ঘটনা ঘটেছে — যার মধ্যে হেফাজতে মৃত্যু, রাজনৈতিক মিছিল ভাঙচুর, এবং দলীয় অফিসে সশস্ত্র আক্রমণ অন্তর্ভুক্ত।

 

নির্দিষ্ট উদাহরণ:

  1. গোপালগঞ্জ, জুলাই ২০২৫: স্থানীয় নির্বাচনী সমর্থকদের ওপর ত্রিমাত্রিক পুলিশের ও র‌্যাবের হামলায় অন্তত ৩ জন নিহত।
  2. সাভার, মার্চ ২০২৫: এক শান্তিপূর্ণ সভার সময় পুলিশি হেফাজতে ২ জন আহত এবং ১৫ জন গ্রেফতার।
  3. বগুড়া, জুন ২০২৫: দলীয় অফিসে অভিযান, ৪ জন গুরুতর আহত, ২০+ গ্রেফতার।
  4. ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০২৫: ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’–এ অন্তত ৪৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের মধ্যে ৩ জন মারা যান হেফাজতে।

 

অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভণ্ডামি ও দায়িত্বশীলতার অভাবঃ

গণতন্ত্র কেবল একটি দলের অধিকার রক্ষার নাম নয়, বরং এটি প্রতিপক্ষের অধিকার রক্ষায় সকল রাজনৈতিক শক্তির সম্মিলিত অঙ্গীকার। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—যারা আজ গণতন্ত্রের কথা বলছে, তারাও অতীতের বা বর্তমানের আচরণে প্রতিপক্ষের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ।

– বিএনপি: ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক বিরোধী দমন, গ্রেফতার ও মামলা ব্যবহার করেছে।

– জামায়াত: ধর্মীয় ও রাজনৈতিক লেবেল ব্যবহার করে, বিরোধী দলের ওপর হামলা ও রাজনৈতিক দমনকে স্বাভাবিক দেখায়।

– এনসিপি: মুখে ‘নতুন রাজনীতি’ বলে সমর্থন দাবি করলেও, আওয়ামী লীগের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিষিদ্ধকরণের পক্ষে বক্তব্য দেয়।

 

এই দলগুলোর আচরণ প্রমাণ করে, তারা গণতন্ত্রের আদর্শকে নয়, বরং ক্ষমতার সুযোগকে অগ্রাধিকার দেয়।

মানবাধিকার কর্মীর বিশ্লেষণ: দল নয়, ব্যক্তি অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনুন, আমি কোনো দলের পক্ষের নয়; আমি একজন সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তিত মানবাধিকার কর্মী। আজ আ.লীগকে দমন করা হচ্ছে, কিন্তু কাল হয়তো বিএনপি, পরশু জামাত — তখন কি জনগণ আবারও এই ধরনের নিষেধাজ্ঞার শিকার হবে?

গণতন্ত্রের মূল নীতি হলো: দল নয়, ব্যক্তি অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনুন। সমষ্টিগত নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া সংবিধান ও মানবাধিকারের উভয়ই লঙ্ঘন করে।

 

উপসংহার

রাষ্ট্র যদি সত্যিই ন্যায়বিচার চায় → দল নয়, ব্যক্তি অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনুন।

রাজনৈতিক মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠন গঠনের অধিকার সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে রক্ষা করুন।

গণতন্ত্রের মূলনীতির সুরক্ষা ছাড়া, সংখ্যার খেলা বা দল নিষিদ্ধ করা কেবল “নামমাত্র গণতন্ত্র”, বাস্তবে এটি মানবাধিকারের হত্যা। যখন রাষ্ট্র ১৮% মানুষকে নিষিদ্ধ করে, তখন গণতন্ত্র মরে যায়। আর যখন রাষ্ট্র প্রতিপক্ষের অধিকার রক্ষা করে, তখন গণতন্ত্র বেঁচে ওঠে।

 

লিখেছেনঃ Md. Emdadul Hoque Chowdhury

মানবাধিকার কর্মী ও লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *