ঢাকার এক দুপুরে অফিস শেষ করে বাসে উঠছিলেন তানিয়া। গরম, ধুলা, আর মানুষে ঠাসা পরিবেশে ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি অচেনা হাত এসে ছুঁয়ে গেল। তানিয়া চমকে উঠে তাকালেন, কিন্তু আশেপাশের কেউ তাকাল না। সবাই এমনভাবে চুপ করে রইল, যেন কিছুই ঘটেনি। কেউ বলল না “কি হয়েছে?”, কেউ বলল না “তুমি ঠিক আছো?”। শুধু একটা দৃষ্টির ভারে বোঝা গেল—লজ্জা যেন তারই হওয়া উচিত।
এই একটা দৃশ্যই আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি।
আমাদের এখানে নারীর শরীর মানেই লজ্জার প্রতীক, গোপনের বিষয়, কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিকে কেউ প্রশ্ন করে না।
এটাই আমাদের সামাজিক শিক্ষা—লজ্জা, পাপ, পর্দা—সব দায় মেয়েদের কাঁধে তুলে দেওয়া।
শরীর নিয়ে নীরবতার রাজনীতি
আমাদের পরিবারে, স্কুলে, এমনকি ধর্মীয় শিক্ষাতেও মেয়েদের শেখানো হয়—“চুপ থাকাই ভালো”। ছোটবেলায় যখন প্রথম মাসিক শুরু হয়, মায়েরা মেয়েদের কানে কানে বলেন—“এটা কাউকে বলবে না, লজ্জার বিষয়।”
এই একটিমাত্র বাক্য থেকেই শুরু হয় নারীর শরীর নিয়ে নীরবতার রাজনীতি।
ধীরে ধীরে সেই নীরবতা বাড়তে থাকে।
যৌন হয়রানি, বিয়ের আগে ধর্ষণ, গার্হস্থ্য নির্যাতন—সবই ঢেকে যায় “চুপ করে থাকো” সংস্কৃতিতে। যেন লজ্জা হলো মেয়ের, অপরাধীর নয়।
এই নীরবতা কেবল ঘরের ভেতর নয়—পুরো সমাজব্যবস্থার অংশ। মিডিয়ায় কোনো নারী প্রতিবাদ করলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে—“ওর পোশাক দেখো!”, “এটা আবার কেমন সাহস?”
অথচ কেউ বলে না—“ওকে কেন স্পর্শ করা হলো?”, “কেন তার সম্মতি ছাড়া ওর শরীর নিয়ে মন্তব্য করা হলো?”
আমরা নারী শরীরকে সবসময় “অন্যের বিচারাধীন এলাকা” হিসেবে গড়ে তুলেছি।
যেখানে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র—সবাই মালিক, কিন্তু নারী নিজে নয়।
ধর্মীয় বয়ানে নারীর দেহ
ধর্মের নামে আমাদের সমাজে নারীর দেহের উপর চাপানো হয়েছে অসংখ্য শর্ত।
কেউ বলে পর্দা করো, কেউ বলে ঘরে থাকো, কেউ বলে বিয়ে ছাড়া নারী অসম্পূর্ণ।
কিন্তু কেউ কি বলে যে ধর্মের মৌল বার্তা কখনও লজ্জা নয়, বরং সম্মান?
মহানবী (সা.) যখন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, তখন তিনি তাদের শিক্ষার, সম্পত্তির, এবং সম্মতির কথা বলেছেন—পোশাকের নয়।
তবু ধর্মীয় বক্তারা আজও নারীর শরীর নিয়ন্ত্রণকে ধর্মরক্ষার অংশ বানিয়ে ফেলেছেন।
তাদের বক্তৃতায় নারী হয় “ফিতনা”, “প্রলোভন”, “অশুভের উৎস”।
ফলে সমাজে নারী হয়ে ওঠে এক চলমান অপরাধবোধের প্রতীক।
যেন তার দেহের অস্তিত্বই পুরুষের পতনের কারণ।
এই ভয়াবহ দৃষ্টিভঙ্গিই নারীর শরীরকে “লজ্জা”তে পরিণত করেছে—যার কারণে নারীরা নিজের শরীরকে ভালোবাসতে শেখে না।
নারী শরীর ও সংস্কৃতির দ্বিচারিতা
সংস্কৃতি নারী শরীরকে কখনও পূজা করে, কখনও শাস্তি দেয়।
বিজ্ঞাপনে, নাটকে, সিনেমায় নারী শরীরকে দেখা হয় ভোগের দৃষ্টিতে। কিন্তু বাস্তবে সেই নারী নিজের শরীর নিয়ে মুক্ত হলে সমাজ তাকে ‘অসভ্য’ বলে তিরস্কার করে।
একই সমাজ যেটা গানের মিউজিক ভিডিওতে নারী শরীরকে “বিক্রির উপাদান” বানায়, সেই সমাজ আবার বলে—“মেয়ে মানুষকে এভাবে চলা মানায় না।”
এ এক ভণ্ডামির দুনিয়া, যেখানে নারীর শরীর অন্যের কামনার বিষয়, কিন্তু নিজের ইচ্ছার নয়।
লজ্জার বোঝা: প্রজন্মের পর প্রজন্মে
মায়ের থেকে মেয়ে শেখে লজ্জা, নানির থেকে মা শেখে নীরবতা।
এইভাবে লজ্জার শিক্ষা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।
একসময় মেয়ে নিজেই নিজের শরীরকে ভয় পেতে শেখে।
যখন কোনো শিশু স্কুলে যৌন হয়রানির শিকার হয়, তাকে শেখানো হয়—“এই বিষয়ে কথা বলো না, মুখ বন্ধ রাখো।”
যখন কোনো তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়, তখনও সমাজ বলে—“তুমি কোথায় গিয়েছিলে, কী পরেছিলে?”
অর্থাৎ অপরাধীর নয়, ভুক্তভোগীর শরীরই সবসময় অভিযুক্ত।
এই সংস্কৃতি শুধু নারীর নয়, পুরুষের মনকেও বিকৃত করে।
কারণ ছোটবেলা থেকেই সে দেখে—নারী মানেই দুর্বল, নিয়ন্ত্রণযোগ্য, লজ্জার প্রতীক।
ফলে বড় হয়ে সে ভাবে—তাকানো, মন্তব্য করা, বা নিয়ন্ত্রণ করা তার অধিকার।
সম্মতির ধারণা: এখনো অবুঝ এক সমাজ
সম্মতি বা consent—এই শব্দটা এখনো অনেকের কাছে “পাশ্চাত্য ধারণা” মনে হয়।
কিন্তু এটা কোনো পশ্চিমা ভাবনা নয়, এটা মানবিকতা।
নারীর “না” মানে “না”—এটাই সভ্যতার সূচক।
কিন্তু আমাদের সমাজে “না” মানে লজ্জা, ভয়, কিংবা অভিমান।
একজন মেয়ের নীরবতাকে সম্মতি ধরে নেওয়া হয়।
এখানেই শুরু হয় নিপীড়নের প্রথম ধাপ।
কোনো সম্পর্কেই—বিয়ে, প্রেম, যৌনতা—সম্মতি ছাড়া কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু ধর্মীয় বা সামাজিক কাঠামোতে সম্মতির জায়গাটা খুবই দুর্বল, কারণ সেখানে নারীর শরীরকে দেখা হয় পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে।
নিজের শরীরের অধিকার মানে বিদ্রোহ নয়
যখন কোনো নারী বলে “আমার শরীর, আমার অধিকার”—তখন অনেকেই এটাকে বিদ্রোহ মনে করে।
কিন্তু এটা কোনো বিপ্লব নয়, এটা ন্যায্য দাবি।
একজন পুরুষ যেমন নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, নারীও পারে।
নিজের পোশাক, নিজের চলাফেরা, নিজের ভালোবাসা—এসব নিয়েই তো তার জীবন।
এটা ধর্ম বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নয়, বরং এর ভিতরেই রয়েছে মানবিকতার বীজ।
পুরুষতন্ত্রের অদৃশ্য দেয়াল
আমাদের সমাজে নারী যতই শিক্ষিত হোক, যতই কর্মজীবী হোক—পুরুষতন্ত্রের দেয়াল তার চারপাশে অদৃশ্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
অফিসে সে “অতি আত্মবিশ্বাসী” বলে সমালোচিত হয়, বাসায় সে “অতি আধুনিক” বলে খাটো করা হয়।
অর্থাৎ নারী যতই এগিয়ে যাক, সমাজ তাকে মনে করিয়ে দেয়—“তোমার জায়গা জানো।”
এই জায়গাটা মূলত শরীরের জায়গা—নিয়ন্ত্রিত, পর্দার আড়ালে, ভয় আর লজ্জায় আচ্ছাদিত।
যখন নারী নিজের শরীরকে ভালোবাসে
যেদিন কোনো নারী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরকে ভালোবাসতে শিখে, সেদিন সে সমাজের ভয় হয়।
কারণ ভালোবাসা মানেই আত্মস্বীকৃতি, আর আত্মস্বীকৃতি মানেই ক্ষমতা।
একজন নারী যদি নিজের শরীরকে শ্রদ্ধা করে, তাহলে সে কারও চোখের ভয় পায় না।
সে জানে, তার সৌন্দর্য অন্যের অনুমোদনে নির্ভর করে না।
এই বোঝাপড়া সমাজের জন্য বিপজ্জনক—কারণ তখন নারী আর নিয়ন্ত্রিত থাকে না।
ধর্ম, নারী ও যৌন অধিকার
অনেকে বলে, ধর্মে যৌনতা নিয়ে কথা বলা পাপ।
কিন্তু বাস্তবে ধর্ম সবসময় দায়িত্ব ও সম্মতির কথা বলেছে, repression নয়।
ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু—সব ধর্মেই যৌন সম্পর্ককে বৈধ বলা হয়েছে সম্মতি ও দায়িত্বের ভিত্তিতে।
তাহলে আমরা কেন আজও যৌন শিক্ষাকে নিষিদ্ধ ভাবি?
কারণ আমরা ভয় পাই—জ্ঞান পেলে নারী নিজের সিদ্ধান্ত নেবে।
আমরা চাই নারী অন্ধ থাকুক, যাতে পুরুষের সুবিধা টিকে থাকে।
শরীর মানেই স্বাধীনতা, লজ্জা নয়
নারীর শরীর কোনো পাপের প্রতীক নয়। এটা তার বেঁচে থাকার মাধ্যম, তার অনুভূতির বাহন।
এই শরীরের ভেতরেই সে ভালোবাসে, সৃজন করে, লড়াই করে।
তবু সমাজ তাকে শেখায়—নিজেকে আড়াল করো, নিজেকে গুটিয়ে রাখো।
যেন তার শরীর কেবল অন্যের চোখে বেঁচে থাকে, নিজের চোখে নয়।
কিন্তু সত্যিটা হলো—শরীর নিয়ে সচেতনতা মানে অসভ্যতা নয়, বরং মর্যাদা।
নিজের শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারই মানুষকে মানুষ করে তোলে।
শেষ কথা: লজ্জা কার?
এই সমাজে আজও “লজ্জা” শব্দটা নারীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, যেন জন্মগত দায়িত্ব।
কিন্তু লজ্জা তো তার নয়, যে নির্যাতনের শিকার;
লজ্জা তার, যে নির্যাতন করে।
লজ্জা তার, যে তাকায়, মন্তব্য করে, বা চুপ থেকে অন্যায়কে মেনে নেয়।
লজ্জা তার, যে জানে অন্যের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, তবু ক্ষমতার আনন্দে মেতে থাকে।
নারীর শরীর নিয়ে যে সমাজ এখনো অস্বস্তিতে থাকে, সেই সমাজই আসলে অসুস্থ।
কারণ, শরীর মানেই জীবন—আর জীবন মানেই স্বাধীনতা।
তাই আজও প্রশ্নটা থেকেই যায়—
“শরীর আমার, লজ্জা তোমার কেন?”
—সাদিয়া শারমিন আইশা











