১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকটের সময় জাতিসংঘ চাইলে যে ভূমিকা রাখতে পারে, তা দেখিয়েছিল। তখন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের আগ্রাসন ঠেকাতে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো সশস্ত্র শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। আজকের ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের চলমান হত্যাযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে সেই ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক হলেও বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। গাজায় জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তার পেছনে বেশ কিছু জটিল কারণ রয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো
গাজায় যুদ্ধবিরতি বা মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর প্রস্তাবগুলো বারবার আটকে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ছয়বার ভেটো দিয়েছে। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো আগ্রাসী দেশগুলোর ভেটো ক্ষমতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ অচল হয়ে পড়েছিল। তখন সাধারণ পরিষদ ‘ইউনাইটিং ফর পিস’ প্রস্তাব ব্যবহার করে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই ধরনের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা
জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তাকে শুধুমাত্র একটি সংস্থার ব্যর্থতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। বরং, এটি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত ব্যর্থতা। বিশেষ করে, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এক্ষেত্রে প্রধান বাধা। জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই। এটি কার্যকরভাবে কাজ করে তখনই, যখন সদস্য রাষ্ট্রগুলো হস্তক্ষেপ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমনটা বসনিয়ায় সার্বদের নৃশংসতা রুখতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট হস্তক্ষেপ করলে ঘটেছিল।
- মার্টিন শ, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছেন এবং এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনকে আধুনিক ইতিহাসের অন্যান্য জাতিগত নিধনের ঘটনা থেকে আলাদা করেছেন।
- ডাগ ব্যান্ডো, ক্যাটো ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো, স্পষ্ট করে বলেছেন যে গাজার নৃশংসতার দায় জাতিসংঘের নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের, যা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে এবং একই সাথে জাতিসংঘকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়।
জাতিগত নিধনের ইতিহাস এবং জাতিসংঘের ভূমিকা
রুয়ান্ডা ও বসনিয়ায় ঘটে যাওয়া জাতিগত নিধনের ঘটনাতেও জাতিসংঘের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। রুয়ান্ডায় গণহত্যা সম্পর্কে বারবার সতর্ক করা হলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বসনিয়ায় জাতিগত নিধন বন্ধে জাতিসংঘ প্রথমে ব্যর্থ হলেও, পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এই ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, বৃহৎ শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া একা জাতিসংঘের পক্ষে জাতিগত নিধন বন্ধ করা খুবই কঠিন।
যদিও সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা ভেটো ক্ষমতার কারণে আটকে থাকা নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে পারে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আজ বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদেশে হস্তক্ষেপ করার আগ্রহও কম। তাই, এই জটিল পরিস্থিতিতে গাজায় জাতিসংঘের অসহায়ত্বের মূলে রয়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য এবং সদিচ্ছার অভাব।
আপনি কি মনে করেন, জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ধরনের পরিস্থিতিতে কার্যকরভাবে কাজ করতে হলে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন?











