মাদাগাস্কারের তরুণ প্রজন্মের (জেনারেশন জেড) বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে রাজোয়েলিনা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি ফরাসি সামরিক বিমানে করে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।
ফরাসি সেনা বিমানে করে পলায়ন
রয়টার্সের সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়, রাজধানী আন্তানানারিভো থেকে রাজোয়েলিনা ফরাসি সেনাবাহিনীর একটি ‘কাসা’ উড়োজাহাজে করে দেশ ছাড়েন। স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় সেন্ট মারি বিমানবন্দরে ফরাসি বাহিনীর বিমানটি অবতরণ করলে অল্প সময়ের মধ্যে একটি হেলিকপ্টার এসে প্রেসিডেন্টকে তাতে তুলে নেয়।
ফরাসি গণমাধ্যম রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল (RFI) জানিয়েছে, রাজোয়েলিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর মধ্যে দেশত্যাগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।
প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তাঁর নির্ধারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণ বাতিল করা হয়েছে।
পানি সংকট থেকে শুরু তরুণদের বিক্ষোভ
পানি ও বিদ্যুৎ সংকটের প্রতিবাদে গত ২৫ সেপ্টেম্বর মাদাগাস্কারে তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়।
ধীরে ধীরে দুর্নীতি, শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বিক্ষোভে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নেয় ২০ বছরের নিচে বয়সী তরুণরা, যারা দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি।
এই আন্দোলন দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে তা বাস্তব রাস্তায় রূপ নেয় ‘জেন-জি বিপ্লব’ হিসেবে।
সেনাবাহিনীর একাংশের যোগদান
গত সপ্তাহে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট আন্দোলনে খোলাখুলিভাবে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিলে প্রেসিডেন্টের অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
সেই ইউনিটটি জানায়, তারা কোনো নাগরিকের ওপর গুলি চালাবে না।
বিরোধীদলীয় নেতা ও সংসদ সদস্য সিতেনি র্যানদ্রিয়ানাসোলোনিয়াইকো বলেন,
“সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিট বিক্ষোভকারীদের পাশে দাঁড়ানোর পর প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা দেশ ত্যাগ করেছেন। প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও তাঁর দেশত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।”
ক্ষমতার মূল ঘাঁটি হারিয়ে গেল
২০০৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন রাজোয়েলিনা। দীর্ঘদিন তিনি সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিট ‘ক্যাপসাট’-এর ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন।
কিন্তু এবার সেই ইউনিটই প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগের ঘোষণা দেয়।
এর পরদিন রাজোয়েলিনা এক টেলিভিশন ভাষণে সতর্ক করেন, “দেশে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র চলছে।”
তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়।
অন্তর্বর্তী নেতৃত্বে সিনেট প্রধান
সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট অনুপস্থিত থাকলে সিনেট প্রধান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন।
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলমান সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অন্তত ২২ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন।
দারিদ্র্য ও বৈষম্যের চিত্র
প্রায় তিন কোটি জনসংখ্যার দ্বীপ রাষ্ট্র মাদাগাস্কারে তিন-চতুর্থাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ৪৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্বের সর্বাধিক ভ্যানিলা উৎপাদনকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও নিকেল, কোবাল্ট, টেক্সটাইল ও চিংড়ি রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয় সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলন আফ্রিকার রাজনীতিতে নতুন এক বার্তা দিচ্ছে— যেখানে প্রথাগত ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রজন্ম নিজের অধিকার ও ভবিষ্যৎ দাবি করতে শুরু করেছে।










