বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 8:19 pm
October 29, 2025 8:19 pm

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ: বন্ধের মুখে কক্সবাজার সৈকতের লাইফগার্ড সেবা

 

বাংলাদেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে মুখর থাকে। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ উপভোগ করতে নেমে বহু মানুষই প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে পড়েন। এ ধরনের বিপদে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রহরীর ভূমিকায় ছিলেন একদল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লাইফগার্ড। ঝুঁকি নিয়ে পর্যটকদের জীবন বাঁচানোই যাদের কাজ। তবে অর্থাভাব ও প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেই গুরুত্বপূর্ণ সেবাই এবার বন্ধ হওয়ার পথে।

প্রকল্পের সূচনা ও মেয়াদ শেষের শঙ্কা

২০১২ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পাইলট ভিত্তিতে শুরু হয় লাইফগার্ড কার্যক্রম। দুই বছর পর, ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা রয়াল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউটের (আরএনএলআই) অর্থায়নে ‘সি সেইফ লাইফগার্ড’ নামে এ প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়।

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ২৭ জন প্রশিক্ষিত কর্মী তিন শিফটে সৈকতে টহল দিয়ে আসছেন। লাল-হলুদ পোশাকে তাদের উপস্থিতি পর্যটকদের সাগরে নামতে সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটির মেয়াদ গত বছর শেষ হয়ে যায়। জেলা প্রশাসনের অনুরোধে প্রথমে জুন পর্যন্ত, পরে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হলেও এর পর আর অর্থায়নের নিশ্চয়তা নেই।

‘সি সেইফ লাইফগার্ড’-এর ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, প্রকল্পের বাৎসরিক ব্যয় প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। লাইফগার্ডদের মাসিক বেতন ২০-৪০ হাজার টাকা। “বর্তমান অর্থ কেবল সেপ্টেম্বর পর্যন্তই কার্যক্রম চালাতে সক্ষম। এরপর আর চালানো সম্ভব হবে না,” বলেন তিনি।

মানুষের জীবন বাঁচানোই পেশা ও নেশা

লাইফগার্ডদের কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে একে জীবনের অংশ হিসেবে নিয়েছেন। স্থানীয় যুবক মো. ওসমান বলেন, “আমরা প্রতিদিন পরিবার ছেড়ে সৈকতে ছুটি অন্যের পরিবারের সদস্যদের বাঁচানোর জন্য। তবে প্রকল্প বন্ধ হলে বিপদে পড়বে শুধু পর্যটকেরা নয়, আমাদের পরিবারও।”

লামা থেকে এসে লাইফগার্ড পেশায় যুক্ত হওয়া আবরাম ত্রিপুরা জানান, “আমরা ঝুঁকি না নিলে হয়তো প্রতিদিনই একাধিক মৃত্যুর খবর শুনতে হতো। এ কাজ বন্ধ হয়ে গেলে সাগরে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।”

পরিসংখ্যান বলছে

‘সি সেইফ লাইফগার্ড’-এর তথ্যমতে:

  • গত এক বছরে সৈকতে ভেসে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১ জন পর্যটক
  • একই সময়ে ৭৮ জনকে উদ্ধার করেছে লাইফগার্ডরা
  • গত এক দশকে লাইফগার্ডদের প্রচেষ্টায় ৮০৭ জন পর্যটক মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন
  • তবে এসময় প্রাণ হারিয়েছেন ৬৫ জন

এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, ঝুঁকিপূর্ণ কক্সবাজার সৈকতে লাইফগার্ড কার্যক্রম সরাসরি জীবনরক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

পর্যটক ও স্থানীয়দের উদ্বেগ

পর্যটকরা বলছেন, লাইফগার্ডদের উপস্থিতিতেই তারা নিশ্চিন্তে পরিবার নিয়ে সাগরে নামেন। নোয়াখালী থেকে আসা ইনজামামুল হক বলেন, “লাইফগার্ডের উপস্থিতির কারণে আত্মবিশ্বাস পাই পানিতে নামতে। এ সেবা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা আর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সাগরে আসতে পারব না।”

ঢাকা থেকে আসা আরেক পর্যটক আরিফুল হক বলেন, “আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই সৈকতে নামি। লাইফগার্ড ছাড়া এই সৈকত নিরাপদ থাকবে না।”

স্থানীয় আইনজীবী আব্দুল মন্নান প্রশ্ন তোলেন, “এত গুরুত্বপূর্ণ সেবা কেন এতোদিন ধরে এনজিওর অর্থায়নের উপর নির্ভর করবে? রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে স্থায়ী সমাধান বের করতে হবে।”

প্রশাসনের অবস্থান

ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিআইজি) আপেল মাহমুদ বলেন, “লাইফগার্ড সেবা সৈকতের পর্যটক নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। এটি বন্ধ হওয়া মানে ঝুঁকি বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়া। আমরা ইতোমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট টেবিলে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। ইতিবাচক বার্তা আশা করছি।”

অন্যদিকে জেলা প্রশাসনও জানাচ্ছে, মহানগর প্রশাসন থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যায়ে প্রকল্প অব্যাহত রাখার জন্য যোগাযোগ চলছে। তবে কোনো স্থায়ী সমাধান এখনো নিশ্চিত হয়নি।

ঝুঁকি ও প্রত্যাশা

প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড ছাড়াই যদি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়, তবে পর্যটকদের নিরাপত্তা বড় ধরনের সংকটে পড়বে। কক্সবাজারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র সৈকতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঢেউ পাড়ি দিতে নামেন। বিশেষ করে স্রোত ও জোয়ার-ভাটার কারণে দুর্ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টেকসই সমাধানের জন্য পর্যটন কর্পোরেশন বা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অধীনে স্থায়ী সরকারি অর্থায়ন জরুরি। নতুবা বাংলাদেশে পর্যটনের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় এ সৈকত বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকটে পতিত হবে।

গত এক দশকে সমুদ্র সৈকতে শত শত মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে লাইফগার্ড দল। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেই জীবনরক্ষী সেবাই বিলীন হওয়ার মুখে। ফলে ঝুঁকিতে পড়বে পর্যটকদের নিরাপত্তা, সাথে অনিশ্চয়তায় কয়েক ডজন পরিবারের জীবিকা।

প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—কক্সবাজার সৈকতে পর্যটক সুরক্ষা কি তবে আবারো ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে যাবে?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *