ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মুসলমানদের দানকৃত সম্পত্তি বা ‘ওয়াকফ’ সংক্রান্ত বহুল আলোচিত নতুন আইনের কয়েকটি বিতর্কিত ধারা স্থগিত করেছে। তবে আইনের পুরো অংশ বাতিলের আবেদন নাকচ করেছেন বিচারপতিরা।
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের পার্লামেন্টে গৃহীত ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৫ বিরোধী দল ও বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন আদালতে চ্যালেঞ্জ করে। তাদের অভিযোগ, আইনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকার খর্ব করছে। অন্যদিকে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার দাবি করছে, এই আইন ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
ওয়াকফ কী?
ইসলামিক প্রথায় ‘ওয়াকফ’ বলতে বোঝায় ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে মুসলমানদের দানকৃত সম্পত্তি, যেমন — মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা বা অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের সম্পত্তি বিক্রি করা বা ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায় না।
১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী, এসব সম্পত্তি পরিচালনার জন্য রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ড গঠন বাধ্যতামূলক ছিল।
নতুন আইনের বিতর্কিত ধারা
বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার আনা সংশোধনীতে একাধিক পরিবর্তন আনে। এর মধ্যে ছিল—
- কোন সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে গণ্য হবে, তা নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে দেওয়া।
- দাতার পরিচয় যাচাইয়ের শর্ত হিসেবে অন্তত পাঁচ বছর ধরে মুসলিম ধর্মাবলম্বী হওয়া আবশ্যক করা।
- ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্তির সুযোগ তৈরি করা।
সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ
সোমবার প্রধান বিচারপতি বি আর গণভাই এবং বিচারপতি এজি মাসিহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রায়ে বলেন, “শুধুমাত্র বিরল ক্ষেত্রেই আইন সম্পূর্ণ স্থগিত রাখা হয়।” তাই তারা পুরো আইন স্থগিত না করে শুধুমাত্র বিতর্কিত ধারাগুলোকে স্থগিত রাখেন।
আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, সরকারের হাতে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানসম্মত ক্ষমতার বিভাজনের পরিপন্থী। কারণ, নাগরিক অধিকার নির্ধারণ করা সরকারের কাজ নয়, বরং বিচার বিভাগের এখতিয়ার।
এছাড়া দাতা অন্তত পাঁচ বছর ধরে মুসলিম হওয়া আবশ্যক—এ বিধানও আদালত বাতিল করেছে।
ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম অন্তর্ভুক্তি
যদিও আদালত পুরোপুরি অমুসলিম সদস্য নিয়োগ স্থগিত করেনি, তবে সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছেন। রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় বোর্ডে সর্বোচ্চ ২২ সদস্যের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪ জন অমুসলিম থাকতে পারবেন। রাজ্য পর্যায়ে ১১ সদস্যের বোর্ডে অমুসলিম সদস্য সর্বাধিক ৩ জন হতে পারবেন।
আদালত আরও নির্দেশ দেন, বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের সময় মুসলিম সম্প্রদায় থেকেই প্রার্থী বাছাই করার চেষ্টা করতে হবে।
প্রেক্ষাপট
সরকারি নথি অনুসারে, ভারতে কাগজে-কলমে অন্তত ৮ লক্ষ ৭২ হাজার ৮৫২টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার ২০০টি মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত, ৫৮ হাজার ৮৮৯টি অবৈধ দখলে এবং ৪ লক্ষ ৩৬ হাজারেরও বেশি সম্পত্তির অবস্থান/মালিকানা অনির্দিষ্ট।
এত বিপুল সম্পত্তির স্বচ্ছ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার দাবি দীর্ঘদিনের। তবে মুসলিম সংগঠনগুলোর অভিযোগ, নতুন আইন আসলে সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও দাতব্য সম্পত্তির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ জোরদারের চেষ্টা মাত্র।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
নতুন আইন পাস হওয়ার পর থেকেই দেশজুড়ে মুসলিম সংগঠন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার ছিল। এপ্রিল মাসেই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায়। তিনদিনব্যাপী দীর্ঘ শুনানির পর গত ২২ মে আদালত রায়ের জন্য আদেশ সংরক্ষণ করে। শেষ পর্যন্ত সোমবার দেওয়া রায়ে আদালত আংশিক স্থগিতাদেশ দিলেও পুরো আইন বহাল রেখেছেন।











