বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 11:48 pm
October 29, 2025 11:48 pm

আইন ও আমাদের সড়ক নিরাপত্তা

বাংলাদেশের সড়ক যেন প্রতিদিনই কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। শুধু গত বছর ৯ মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে পাঁচ হাজার পাঁচশ’রও বেশি মানুষ। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে। মৃত্যুর বাইরে অসংখ্য মানুষ থেকে যাচ্ছেন গুরুতর বা স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতায়, যাদের অনেকেই পাচ্ছেন না ক্ষতিপূরণ কিংবা দ্রুত চিকিৎসাসেবা। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ এক মাসেই ৫৮৭টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন এক হাজার ২৩১ জন।

এমন মর্মান্তিক চিত্র বহু বছর ধরে চলমান দুর্বল সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অকার্যকর আইন প্রয়োগ এবং সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবকে স্পষ্ট করে দেয়।

জরুরি চিকিৎসাসেবার ঘাটতি

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমানোর অন্যতম বড় উপাদান হলো দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসাসেবা। কিন্তু বাংলাদেশের সড়কব্যবস্থায় সেটিই সবচেয়ে বড় ঘাটতি। ২০১৬ সালে এক তরুণ বাসহেলপার দুর্ঘটনার পর জরুরি চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং অন্যান্য সংস্থা হাইকোর্টে রিট করে।

২০১৮ সালে হাইকোর্ট ঘরে-বাইরে আলোচিত এক রায়ে নির্দেশনা দেয়—

  • সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকে আর্থিক সামর্থ্যের বিচারে নয়, জরুরি ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনার শিকারদের সেবা দিতে হবে
  • প্রতিটি হাসপাতালে জরুরি বিভাগ, পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতি ও অ্যাম্বুলেন্স নিশ্চিত করতে হবে
  • “গুড স্যামারিটান” বা দুর্ঘটনায় সহায়তাকারীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
  • স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে গেজেট আকারে নির্দেশনা প্রকাশ করে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে

তবে এত স্পষ্ট নির্দেশনার পরও আজও দেশে একক কোনো জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা নেই। অ্যাম্বুলেন্সগুলোর অনেকই অচল বা অপ্রস্তুত, এবং মন্ত্রণালয়ের গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বড় অংশই আদালতের নির্দেশ অবগত নয়।

ক্ষতিপূরণের জটিলতা

ক্ষতিগ্রস্ত বা নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হয় সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ দ্বারা, যা মোটর ভেহিকেলস অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ প্রতিস্থাপন করেছে। আইন অনুযায়ী, মালিক এককভাবে দায়ী না থেকে ক্ষতিপূরণের জন্য একটি ফান্ড গঠিত হবে। এ ফান্ডে আসবে সরকারি অনুদান, আইন অনুযায়ী জরিমানার অর্থ, যানবাহন মালিকদের বার্ষিক অবদান এবং শ্রমিক-মালিক সমিতির দান।

তবে সমস্যার জায়গা হলো— ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ নির্ধারণে আইনে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। আঘাতের মাত্রা অনুযায়ী অর্থ নির্ধারণের সুনির্দিষ্ট কাঠামো নেই, মৃত্যুর পরও নির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়নি। ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা অনেক সময় ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক অনেক সময় হাস্যকরভাবে কম হয়।

চালকদের অবহেলিত অধিকার

অপরিহার্য অংশীদার হয়েও চালকদের অধিকার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৩৯ ধারায় বলা হয়েছে— সরকার গেজেটের মাধ্যমে চালক, সহকারী ও পরিষ্কারকর্মীদের কাজের সময় ও বিশ্রামের সময় নির্ধারণ করতে পারবে।

কিন্তু বাস্তবে চালকদের অধিকাংশকেই কাজ করতে হয় দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা। “নো ওয়ার্ক, নো পে” পদ্ধতিতে প্রতিটি ট্রিপের ভিত্তিতে বেতন পাওয়ার কারণে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তারা বাধ্য হচ্ছেন ঝুঁকিপূর্ণ দ্রুতগতির ড্রাইভিং-এ। এর ফলে মানসিক চাপ, ক্লান্তি ও অসতর্কতা যুক্ত হয়ে অহরহ ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

বিচারের দীর্ঘসূত্রতা

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট একটি সড়ক দুর্ঘটনা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। নিহত হন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মিশুক মুনিয়ার। ওই ঘটনায় তাদের পরিবার এখনো ক্ষতিপূরণ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পাননি। হাইকোর্ট ৭ বছর আগে রায় দিলেও আপিল বিভাগে এখনো শুনানি শুরু হয়নি।

করণীয়

অথচ সমাধান একেবারেই অসম্ভব নয়। জরুরি চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করতে হবে এবং সারাদেশে একীভূত ‘ইমারজেন্সি রেসপন্স সিস্টেম’ চালু করতে হবে।
ক্ষতিপূরণের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের আঘাতের মাত্রা ও মৃত্যুর ভিত্তিতে নির্দিষ্ট স্কিমের মাধ্যমে অর্থ প্রদানের বিধান করতে হবে।
চালক ও সহকারীদের কাজের সময় ও বিশ্রামের অধিকার আইনি কাঠামোয় কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ প্রয়োগই পারে সড়কে মৃত্যু ও কান্নার মিছিল কমাতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *