বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 10:40 pm
October 29, 2025 10:40 pm

কেন বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে ‘ইলেকট্রনিক ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাক্ট’ প্রয়োজন

গত এক দশকে বাংলাদেশের বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশগুলো যখন সীমান্ত বাণিজ্য প্রক্রিয়াকে দ্রুত ডিজিটাল করছে, বাংলাদেশ তখনও নির্ভর করছে কাগজনির্ভর, খণ্ডিত ও জটিল ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ার ওপর। ফলে রফতানিকারকরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

বাংলাদেশের সীমান্ত বাণিজ্য ব্যবস্থায় বর্তমানে শুল্ক, বন্দর কর্তৃপক্ষসহ একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করছে, যাদের আলাদা কাগজপত্র, ফি এবং ডেটা ফরম্যাটের কারণে একটি চালানকে একাধিক জায়গায় ঘুরতে হয়। এ প্রক্রিয়ায় সময়, অর্থ ও শ্রম অপচয় হচ্ছে; একই সঙ্গে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাও বেড়ে যাচ্ছে।

শত শত ছিন্নমূল আইন, অধ্যাদেশ ও প্রবিধান দিয়ে গড়ে ওঠা এ ব্যবস্থার অনেক বিধানই বর্তমানে অপ্রচলিত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কাস্টমস অ্যাক্ট ২০২৩ কিংবা আমদানি নীতি আদেশ—এসব আইন কেবল আংশিক দিক কাভার করে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ডেটা-শেয়ারিং, ই-পেমেন্ট ও ঝুঁকি-ভিত্তিক ছাড়পত্র সম্পূর্ণ অবহেলিত।

প্রেক্ষাপট: ডব্লিউটিও এবং এলডিসি উত্তরণ

বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি আরও জরুরি কারণ দেশটি ২০২৬ সালে সর্বনিম্ন উন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পথে। এছাড়া ২০২৫-২০৩০ মেয়াদের মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্ট (টিএফএ) ক্যাটাগরি ‘সি’-এর প্রতিশ্রুতি পূরণও করতে হবে। সেই দিক থেকে ইলেকট্রনিক ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাক্ট (ইটিএফএ) পাসের তাগিদ বাড়ছে।

কী দেবে এই আইন?

ইটিএফএ কোনো একক নিয়মের সংযোজন নয়, বরং এটি পুরো বাণিজ্য প্রক্রিয়াকে নতুন কাঠামো দেবে। এ আইন পাস হলে:

  • সব সীমান্ত সংস্থাকে একটি একীভূত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে বাধ্য করা হবে।
  • প্রতিটি অনুমতি, প্রত্যয়নপত্র, পরিশোধ ও পরীক্ষার তথ্য অনলাইনে প্রবাহিত হবে, ফলে বিলম্ব ও কাগজনির্ভর দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
  • ঝুঁকি-ভিত্তিক (Risk Management) ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থা চালু হবে, যাতে পচনশীল পণ্য দ্রুত ছাড়পত্র পায়।
  • বাংলাদেশ সিঙ্গল উইন্ডো (BSW) কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং সব সংস্থাকে এতে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক হবে।
  • বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে (MoC) বার্ষিক ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন পর্যালোচনা প্রকাশে আইনগতভাবে বাধ্য করা হবে।

বর্তমান চ্যালেঞ্জ

মন্ত্রণালয় এখন কোনো সংস্থাকে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় বাধ্য করতে পারে না, ফলে সংস্কার থেমে যায়। ন্যাশনাল ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কমিটি (NTFC)-এর সিদ্ধান্তগুলোও আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় বাস্তবায়িত হয় না। এ কারণে সেকেন্ড টেস্টিং ও ঝুঁকি-ভিত্তিক পদ্ধতির মতো সংস্কার অচল হয়ে আছে। আবার বাংলাদেশ সিঙ্গল উইন্ডো বারবার সময়সীমা পেছাচ্ছে, কারণ এর সঙ্গে সংস্থা যুক্ত হওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।

ইটিএফএ এ ঘাটতিগুলো পূরণ করবে। এটি এনটিএফসি-কে আইনগত কর্তৃত্ব দেবে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সময়সীমা বাস্তবায়নের ক্ষমতা দেবে এবং প্রতিটি সংস্থাকে সিঙ্গল উইন্ডোতে যুক্ত হতে বাধ্য করবে।

বৈশ্বিক উদাহরণ

বাণিজ্যকে ডিজিটাল করার সফল উদাহরণ বহু দেশে রয়েছে।

  • যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যান্ড ট্রেড এনফোর্সমেন্ট অ্যাক্ট ঝুঁকি-ভিত্তিক পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করেছে।
  • দক্ষিণ কোরিয়া ২০০৫ সালে ইলেকট্রনিক ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ডিজিটাল একক উইন্ডো চালু করে।
  • পরবর্তীতে মরিশাস, নাইজেরিয়া ও জাম্বিয়ার মতো দেশগুলো একই ধারা অনুসরণ করেছে।

সম্ভাব্য সুফল

ইটিএফএ বাস্তবায়নের মাধ্যমে—

  • ফাইল জমা ও ই-পেমেন্ট হবে অনলাইনে, বাদ পড়বে নগদ ফি ও দপ্তরে লাইন ধরা।
  • গ্রিন লেন ব্যবস্থায় বিশ্বাসযোগ্য রফতানিকারকের পণ্য দ্রুত ছাড়পত্র পাবে।
  • একীভূত ওয়েব পোর্টালে শুল্কহার, নিয়মনীতি ও ছাড়পত্রের রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং ব্যবসায়ীদের তথ্য খরচ কমাবে।
  • ব্যবসায়ীরা বিলম্বের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন।
  • সর্বোপরি রপ্তানি-আমদানির প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং এলডিসি-পরবর্তী বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

উপসংহার

বাংলাদেশ সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে। এলডিসি থেকে উত্তরণের এই সময়ে ইলেকট্রনিক ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাক্ট কেবল আইন সংস্কার নয়, বরং বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবস্থাকে একবিংশ শতাব্দীর গতিশীল অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার অপরিহার্য ভিত্তি। সঠিক সময়ে এ আইন প্রণয়ন করলে কেবল বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগোনোই নয়, বরং সুশাসন, স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *