মির্জাপুরের প্রগতিশীল ও মুক্তমনা চিন্তক রাশেদুল ইসলাম এবং তার পরিবার আজও দিন কাটাচ্ছে ভয় ও আতঙ্কে। পরিবার ও স্বজনদের বর্ণনা অনুযায়ী ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া হুমকি, হামলা এবং মামলাবাজি তাদের জীবনকে এক দীর্ঘপর্বের নির্বাসনে পরিণত করেছে — এমনকি ছেলের উচ্চশিক্ষা ও বাইরে থাকার পরেও পরিবারটি নিরাপদ নয়।
রাশেদুল—একজন মুক্তিযোদ্ধা পিতার ছেলে, এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় বক্তা ও লেখক—তার চিন্তাভাবনা ও লেখালিখির কারণে মৌলবাদী জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়। পরিবারে বাবা জাহাঙ্গীর আলম, মা রিনা বেগম এবং দুই ছোট ভাই ওমর ফারুক ও রেদওয়ান ইসলাম; তাঁদের জীবনে বড় পরিবর্তন শুরু হয় ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে, যখন ঢাকায় এক সন্ধ্যায় উগ্রপন্থী হামলায় রাশেদুলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে কলাবাগান এলাকায় ফেলে রাখা হয়। ওই আঘাতে তার ডান চোখের দৃষ্টি নষ্ট হয় — এবং পুরো পরিবার তখন থেকেই এক দীর্ঘ সন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে বাস করে আসছে।
পরিবারের বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনার পরে স্থানীয় স্তরে প্রাণনাশের হুমকি, উগ্রবাদী দলের সদস্যদের বাড়িতে এসে হুমকি-ধামকি চলতে থাকে। জঙ্গিবাদী মোল্লারা পরিস্কার ভাষায় বলে যায় যে -বাংলাদেশে ইসলাম বিরোধি মতবাদ প্রচার করলে রাশেদুলের পরিনতি হবে নির্বাসিত লেখিকা তসলিম নাসরিনের মত, পরিবারে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না । এ বিষয়ে বহুবার স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা করে ও লাভ হয়নি । “থানায় অভিযোগ করলে ওরা বলেন—কাজ হবে না, তুমি সাবধানে থাকো” নিরাপত্তা বিবেচনায় ২০০৭ সালের মাঝামাঝি রাশেদুলকে সে সময় স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়; কিন্তু বিদেশে থাকা সত্ত্বেও হুমকি ও মামলার ছায়া শেষ হয়নি।
২০১৩ সালে মৌলবাদীরা ইসলাম অবমানোনার অভিযোগে সারা দেশে কঠোর আন্দোলন শুরু করে, বিশ্বেষ যুদ্ধ আপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রগতিশীল মুক্ত মনা দের শাহাবাগী আন্দোলনকে ন্স্যাত করতে তারা টার্গেট করে জনপ্রিয় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের গুপ্ত হত্যা শুরু করে। ততদিনে বিলেতে রাশেদুলের কোর্স কমপ্লিট -ভিসা ও শেষ, বিলেতের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দেশে ফেরার পালা। কিন্ত আতঙ্কিত বাবা মা রাশেদুলকে দেশে না ফিরতে অনুরোধ করে-“ তুমি দূরে থাক , তবু বেচে থাক – এটাই আমরা চাই” – মুঠোফোনে শুধু এ কথাটাই বলেছিল মা রিনা বেগম
এরপর, ২০১৬ দেশে ঘটে যায় হলি আর্টিসের সেই ভয়াবহ জঙ্গি ঘটনা, আর তার কিছুদিন পর আরেক প্রগতিশীল মুক্তমনা লেখক অভিজিত ঢাকার বই মেলা প্রাঙ্গনে নির্মমভাবে হত্যা করে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা। পরিস্থিতি, এতটা খারাপ হয়ে যায় যে রাশেদুলের আর দেশে ফেরা হয় না। ২০১৭ সালে বাবা জাহাঙ্গীর আলম মৃত্যুবরণ করলেও রাশেদুল দেশে ফিরে শেষকৃত্যে এসে দাঁড়াতে পারেননি বলে পরিবারের সদস্যরা জানান।
গত বছর এবং চলতি বছরের ঘটনাবলি তাদের দুশ্চিন্তা আরও তীব্র করেছে বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক ঘটনাবলির পর উগ্রবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবারের ওপর নতুন করে চাপ বেড়ে যায়। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে, রাশেদুলের নামে স্থানীয় থানার পুলিশ ওয়ারেন্ট নিয়ে বাড়িতে আসে তাকে গ্রেফতার করার জন্য। রিনা বেগম জানে না কি মামলা হয়েছে তার ছেলে রাশেদুলের নামে। তার ছেলে তো কোন অপরাধ করে নি, সে যে এখন এ দেশেই নাই তার পর ও তার নামে কেন মামলা হল তা তিনি বুঝে উঠতে পাছেন না ।
রাশেদুল বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যমে তার চিন্তাভাবনা দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকায় উগ্র সংগঠনগুলোর নজর থেকে সে মুক্ত নয়—এ কারণেই পরিবার বরাবরই লক্ষ্যবস্তুতে।
এ বছরের অক্টোবর মাসের ৩ তারিখ শুক্রবার, স্থানীয় বাজারে রাশেদুলের ছোট ভাই ওমর ফারুককে আক্রমণ করে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা; পরিবারের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের উদ্দেশ্য ছিল ওমর ফারুকের পায়ের রগ কাটার চেষ্টা—সামনে যদি রাশেদুল তাঁর কর্মকাণ্ড বন্ধ না করেন, তাহলে পরিবারের কেউ রক্ষা পাবে না, এমনই বার্তা তারা পেয়েছেন। পরিবারটি ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে—এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা স্বাধীন দেশে আজ সুরক্ষার আশ্বাস পাচ্ছে না তা এই জাতির জন্য লজ্জার বিষয় বলে সমাজের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
এই পরিবারকেন্দ্রিক কাহিনী শুধু এক সদস্য বা এক পরিবারকে ঘিরে সীমাবদ্ধ নয়; এটি স্বাধীন মতপ্রকাশ, আইনশৃঙ্খলা এবং নাগরিক নিরাপত্তার বড় প্রশ্ন তোলে। একদিকে আছে মতের ওপরে আঘাত, অন্যদিকে আছে একটি মুক্ত দেশের নাগরিকদের—বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের—নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তার দাবি।










