বাংলাদেশের মতো একটি দেশ নিয়ে কেন আমেরিকা এত আগ্রহী, এই প্রশ্নটি অনেকের মনেই আসে। অনেকে মনে করেন, উগ্র ডানপন্থী বা মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক রাখাটা তাদের ঘোষিত মৌলবাদ-বিরোধী নীতির পরিপন্থী। তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা সম্ভব নয়; এটি আসলে এক জটিল কৌশলের খেলা।
একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যাক। ধরা যাক, আপনি আপনার অপছন্দের প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি করাতে চান। আপনি সরাসরি চুরি করার বদলে এমন একটি পরিকল্পনা করলেন যেন তার বাড়ির সামনে একটি বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। এতে করে তার বাড়িতে আসা-যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আপনি এসে সেই ডাল সরিয়ে তার সাহায্যকারী হিসেবে হাজির হলেন। এটি হলো “রিঅ্যাকটিভ স্ট্র্যাটেজি”—যেখানে আপনি সরাসরি কিছু চাপিয়ে না দিয়ে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেন, যার প্রতিক্রিয়া আপনার পক্ষে আসে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমেরিকার কৌশলও অনেকটা এরকমই ছিল।
২০০১ সালের নির্বাচন এবং গ্যাস কূটনীতি
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বারবার বলেছিলেন যে আমেরিকা তার দলের বিপক্ষে ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতকে প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রির জন্য চাপ দেওয়া। সেসময় দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে এমন খবর ছড়ানো হয়েছিল যে বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে এবং এখানে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। কিন্তু এই তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
আসলে, এটি ছিল একটি বৃহত্তর মার্কিন কৌশলের অংশ। এই কৌশলটি বুঝতে হলে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইরানের দিকে তাকাতে হবে। সেসময় আমেরিকা ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু ইরান, পাকিস্তান ও ভারত মিলে একটি বিশাল আন্তঃদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প (IPI) হাতে নিয়েছিল, যার মাধ্যমে ইরান থেকে গ্যাস ভারত ও পাকিস্তানে সরবরাহ করা হতো। ভারত ছিল এই প্রকল্পের একটি বড় বাজার, এবং এই পাইপলাইন সফল হলে ইরানের নিষেধাজ্ঞাগুলো অনেকটাই অকার্যকর হয়ে যেত।
আমেরিকা কোনোভাবেই চায়নি ভারত এই প্রকল্পে যুক্ত হোক। তাই তারা এমন একটি বিকল্প পথ খুঁজছিল যাতে ভারত IPI প্রকল্প থেকে সরে আসে। তাদের কৌশল ছিল, যদি ভারতকে বোঝানো যায় যে বাংলাদেশের কাছে বিশাল পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে এবং তা তারা কম দামে পেতে পারে, তাহলে ভারত স্বাভাবিকভাবেই IPI প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আর এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল।
প্রত্যাখ্যান, প্রতিক্রিয়া এবং রাজনৈতিক পরিণতি
শেখ হাসিনা এবং তার সরকার আমেরিকার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা ক্ষুব্ধ হয় এবং তারা তাদের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় আসে, কিন্তু এটি ১৯৯১ সালের বিএনপির মতো ছিল না। এই দলটি আরও বেশি আগ্রাসী এবং সন্ত্রাসী চরিত্রের হয়ে ওঠে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল র্যাবের সৃষ্টি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের পর ক্ষমতা না ছাড়ার প্রবণতা।
তবে সময়ের পরিক্রমায় দেখা যায়, বাংলাদেশে আসলে বিশাল কোনো প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ছিল না, এবং আমেরিকার এই কৌশলটি সফল হয়নি। ৯/১১ এর ঘটনা এবং আফগান যুদ্ধের কারণে IPI পাইপলাইন প্রকল্পটি আর বাস্তবায়িত হয় না। ভারত এই প্রকল্প থেকে সরে আসে, এবং এটি কেবল ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সম্প্রতি আমেরিকা পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে এই পাইপলাইন নিয়ে এগোলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
আমেরিকার এই পরিকল্পনা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে রয়ে গেছে। এটি প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য কতটা জটিল এবং প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করা হতে পারে। এই কৌশলের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলস্বরূপই আমাদের রাজনীতিতে সহিংসতা এবং উগ্রবাদের বিস্তার ঘটেছিল।











