বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 29, 2025 8:23 pm
October 29, 2025 8:23 pm

মানুষের পরিচয় কি শুধুই লিঙ্গ ও পেশা? রাষ্ট্র কি মানুষ হিসেবে দেখছে নাগরিককে?

Md. Emdadul Hoque Chowdhury

মানুষের পরিচয় কি শুধুমাত্র তার লিঙ্গ, পেশা বা সামাজিক অবস্থান দ্বারা নির্ধারিত হবে? নাকি তার চেয়ে বড় একটি পরিচয় আছে—সে মানুষ? একজন মানুষের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, চিন্তাভাবনা, মত প্রকাশের অধিকার, কর্মের অধিকার, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—নিজের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের স্বাধীনতা। এই অধিকারগুলো কোনো অনুগ্রহ নয়; এগুলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সংবিধানিক অধিকার।

কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। সম্প্রতি রাজধানীর এক র‍্যালিতে দেখা গেছে এক যুবক হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে লেখা—“homosexuality & prostitution are not human rights”। সেই দৃশ্য কেবল একজন নাগরিকের ঘৃণাপূর্ণ মনোভাবের প্রকাশ নয়; এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের নীরবতার প্রতিফলন। যখন একটি রাষ্ট্র সংবিধানে বলে যে “সব নাগরিক সমান”, অথচ এমন হুমকি ও অপমানের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তখন প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্র কি সত্যিই নাগরিকদের প্রতি ন্যায়বিচার করে?

সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বনাম কঠিন বাস্তবতা:

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে: সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম বা জন্মগত পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য করা যাবে না। এই অধিকারগুলো কোনো করুণা নয়, বরং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। একজন মানুষের রয়েছে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, আত্মমর্যাদা, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার এবং সবচেয়ে জরুরি—নিজের লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু বাস্তবে, এই সাংবিধানিক অধিকারের বাস্তবায়ন লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে অনন্যায়ের দিকে ধাবিত।

পরিসংখ্যানে বৈষম্যের চিত্র:

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK)-এর তথ্যমতে, বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে:

  • সহিংসতা: ২০২৩ সালে কমপক্ষে ১৯ জন লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানুষ হত্যা বা গুরুতর নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
  • হয়রানি: গত পাঁচ বছরে নথিভুক্ত হয়রানির ঘটনা ২০০-এর বেশি; এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে যে তা ঘটেছে পুলিশ বা প্রশাসনের উপস্থিতিতে।
  • কর্মসংস্থান বঞ্চনা: ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯০% স্থায়ী ও সম্মানজনক চাকরি পায় না। এই বঞ্চনার ফলেই তারা বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বা যৌনপেশার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ঠেলে পড়ে।

এই পরিসংখ্যান রাষ্ট্রের নীরবতাকে স্পষ্ট করে। রাষ্ট্র আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, এবং আদমশুমারির মতো নাগরিকত্বের প্রাথমিক কাঠামো নির্মাণ করেছে ঠিকই, কিন্তু নাগরিককে তার আত্ম-পরিচয় ও মর্যাদার অধিকার এখনও দিতে পারেনি।

সরকারের প্রতীকী পদক্ষেপ: বাস্তব ব্যর্থতার আড়াল?

২০১৩ সালে সরকার ‘তৃতীয় লিঙ্গ’-কে স্বীকৃতি দেয়, যা একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হয়েছে যে এটি ছিল মূলত একটি প্রতীকী উদ্যোগ, যা বাস্তব পরিবর্তনের পথে যথেষ্ট নয়।

  • আইনের অভাব: স্বীকৃতির এক দশক পার হলেও কোনো অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন আইন বা বৈষম্য-বিরোধী আইন এখনও পাস হয়নি। ফলে বৈষম্য ও হয়রানির শিকার নাগরিকরা আইনি সুরক্ষা পাচ্ছে না।
  • প্রশাসনিক সংবেদনশীলতার ঘাটতি: পুলিশ বা প্রশাসনের জন্য লিঙ্গ সংবেদনশীল (Gender Sensitization) প্রশিক্ষণ নেই বললেই চলে। ফলস্বরূপ, অভিযোগ জানাতে গেলে আদালত ও প্রশাসন প্রায়শই অভিযোগ দায়িত্ব এড়িয়ে যায়, এবং ঘৃণার শিকার নাগরিককে উল্টো ‘অশ্লীলতা’ বা ‘অপরাধী’ হিসেবে বিচ্যুত করার ঘটনা ঘটে।
  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এখনও রয়েছে তীব্র সামাজিক বাধা ও প্রতিষ্ঠানিক বৈষম্য।

ঘৃণার প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানো যুবকের দৃশ্যটি তাই কেবল সামাজিক অসহিষ্ণুতা নয়, এটি আসলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা ও নীরবতার সুস্পষ্ট চিহ্ন।

 

মৌলবাদী শক্তি ও রাজনীতির দরকষাকষি:

বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যুগুলো প্রায়শই রাজনীতির মাঠে ‘কৌশলগত শামুক’-এর মতো ব্যবহৃত হয়। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতা দখলের দৌড়ে থাকা কোনো রাজনৈতিক দলই মৌলবাদী শক্তিকে বিরক্ত করতে স্পষ্ট অবস্থান নেয় না।

মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় এখনও “হিজড়া বা সমকামিতা হারাম”-এর মতো বিদ্বেষপূর্ণ শিক্ষা দেওয়া হয়। সরকার এই শিক্ষাব্যবস্থায় বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিলেও এর অভ্যন্তরীণ সংস্কার বা মানবাধিকারের আলোকে পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। ফলে, মানবাধিকার আজ আর কোনো নৈতিক বা সাংবিধানিক ইস্যু নয়; এটি পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দরকষাকষি ও ক্ষমতার লেনদেনের একটি পণ্যে।

 

সমাধানের পথ: পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন

মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার জন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণের দিকে এগিয়ে আসতে হবে।

  • অবৈষম্য আইন প্রণয়ন লিঙ্গ, যৌনতা ও পেশাভিত্তিক বৈষম্যকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে
  • পুলিশ ও প্রশাসনের প্রশিক্ষণ Gender Sensitization বাধ্যতামূলক করতে হবে
  • গণমাধ্যম ও শিক্ষায় ইতিবাচক উপস্থাপনা পাঠ্যপুস্তক, নাটক, সংবাদ মাধ্যমে বৈচিত্র্যের সম্মানজনক চিত্র উপস্থাপন
  • কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা সরকারি-বেসরকারি খাতে স্কিল ট্রেনিং ও কোটা ব্যবস্থা
  • ঘৃণামূলক বক্তব্য ও উসকানিমূলক প্রচারণার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

 

শেষ কথা: রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা

মানুষকে তার জন্মগত সত্তা এবং মর্যাদার ভিত্তিতে দেখার অধিকার কখনও বাতিল হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি নাগরিককে তার লিঙ্গ পরিচয়, যৌনতা বা জীবিকার কারণে কোণঠাসা করে বা বাঁচতে না দেয়, তবে সে নিজেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করতে পারে না; সে পরিণত হয় অধিকারহীনতার এক কারাগারে।

যুবকের প্ল্যাকার্ডে লেখা “homosexuality & prostitution are not human rights”—এই উক্তিটি কেবল সমাজের ভেতরের ঘৃণা নয়, এটি রাষ্ট্রের নীরব প্রতিহিংসা ও দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রতীক। আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে প্রশ্নটা তাই অত্যন্ত জরুরি: মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে রাজি কি রাষ্ট্র?

 

✍ লেখক: Md. Emdadul Hoque Chowdhury

মানবাধিকার কর্মী ও লেখক

3 Responses

  1. লিঙ্গের হিসাব নিকাশ শেষ না হওয়া আপনার কোন কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।পৃথিবীর শুরু থেকে দুই লিঙ্গ কোন হিসাব করার আগেই প্রকাশ পায়। নতুন নতুন লিঙ্গ আবিস্কার বন্ধ করতে হবে।মানুষের পরিচয় হওয়া উচিত যে ভাবে সৃষ্টিকর্তা পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

  2. এই কোন মহান চিন্তাবিদ লেখক এসেছেন যে দেশের ভিতরে পশুর মত আচরণ করে তাদের পক্ষে ভালোবাসা নিয়ে। তার পুটকির ভিতরে বাঁশ ডলা দিলে বুঝবো, অতি মানবতাবাদী হলে কি হয়! সে জগন‍্য নোংরা চিন্তার লোক তাকে জেলে দেওয়া উচিত। এই কুকুরের বাচ্চার মত লোকদের কারণে দেশের ভিতর অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি তার পরিচয় ও ঠিকানা পেলে পেলে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।

  3. এই লোককে ধরে মেরে পুলিশে দেওয়া উচিত। সে আমাদের প্রিয় মুসলিম দেশের ভিতরে নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। কেউ আমাকে তার খোঁজ দেন তাহলে তার লেখার হাত ভেঙ্গে দিব। আমাদের দেশের সরকার ও প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *