বাংলাদেশে গবাদিপশুর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের খবর নতুন নয়। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই রোগে আক্রান্ত পশু ও মানুষের খবর পাওয়া যায়। প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়া এই সংক্রামক রোগটি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে আসছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন জানান, “অ্যানথ্রাক্স একটি প্রাণীবাহিত ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, যার জীবাণু হলো Bacillus anthracis। এটি মাটিতে বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে এবং সুযোগ পেলেই পশু ও মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়।”
অ্যানথ্রাক্স কীভাবে ছড়ায়
অ্যানথ্রাক্স সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া বা অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায়।
সংক্রমণের প্রধান ধাপগুলো হলো:
- আক্রান্ত পশুর রক্ত, মাংস বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে মানুষের দেহে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করতে পারে।
- ঘাস খাওয়ার সময় পশুর মুখে ক্ষত থাকলে মাটিতে থাকা অ্যানথ্রাক্স স্পোর সেই ক্ষত দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে।
- আক্রান্ত পশু জবাই করে মাংস বিক্রি বা খাওয়ার মাধ্যমে রোগ আরও ছড়িয়ে পড়ে।
মনে রাখতে হবে, অ্যানথ্রাক্স মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না, বরং প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়।
অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের ধরন ও লক্ষণ
১️⃣ ত্বকের অ্যানথ্রাক্স (Cutaneous Anthrax)
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই ধরনটি। আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে এলে ত্বকের ক্ষত দিয়ে জীবাণু ঢুকে পড়ে।
লক্ষণ:
- জ্বর, চুলকানি ও ফুসকুড়ি
- ত্বকে ফোস্কা বা ঘা সৃষ্টি হয়ে কালো রঙ ধারণ করে
- আক্রান্ত স্থানে ব্যথা ও ফুলে যাওয়া
পরিপাকতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স (Gastrointestinal Anthrax)
আধা সেদ্ধ বা কাঁচা মাংস খাওয়ার মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটে।
লক্ষণ:
- পেটব্যথা, বমি, জ্বর, ডায়রিয়া
- কখনও রক্তবমিও হতে পারে
শ্বাসতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স (Pulmonary Anthrax)
ট্যানারিতে বা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় স্পোর শ্বাসনালিতে প্রবেশ করলে হয়।
লক্ষণ:
- শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, জ্বর
- গুরুতর ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনটি বিরল হলেও সবচেয়ে বিপজ্জনক। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এটি বায়ো-ওয়ারফেয়ার বা জীবাণু অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।
চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা
আইইডিসিআর ইতোমধ্যে অ্যানথ্রাক্স চিকিৎসার জন্য জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করেছে।
চিকিৎসার মূলধাপগুলো হলো:
- সঠিকভাবে নির্ণয়ের পর অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ
- ক্ষতের স্থানে অ্যান্টিবায়োটিক মলম ব্যবহার
- জটিল ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করে পর্যবেক্ষণ
ডা. মুশতাক বলেন, “সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে অ্যানথ্রাক্স সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। তবে দেরি হলে রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে।”
অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধে করণীয়
আক্রান্ত বা মৃত পশুর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
আক্রান্ত পশু জবাই বা মাংস বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কাঁচা বা আধা সেদ্ধ মাংস খাওয়া যাবে না।
নিয়মিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা প্রদান করতে হবে।
অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত এলাকায় অন্তত ১০ কিলোমিটারের মধ্যে সব গবাদিপশুকে টিকা দিতে হবে।
মৃত পশু পুড়িয়ে ফেলা বা গভীরভাবে মাটিচাপা দিতে হবে।
স্থানীয় প্রশাসনকে আক্রান্ত পশুর মাংস বিক্রির ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে।
পশুশ্রমিক ও কসাইদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সতর্কতার বার্তা
দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। যদিও এটি আতঙ্কের নয়, তবে সচেতনতার অভাব বিপদের কারণ হতে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত টিকা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ।











