বিশ্বজুড়ে খবর, এক ক্লিকেই

October 30, 2025 7:29 am
October 30, 2025 7:29 am

মুসলিম বিশ্বে ন্যাটোর আদলে যৌথ সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব, ইসরায়েলবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার ডাক

কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত এক অভূতপূর্ব সম্মেলনে আরব লীগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতারা এক মঞ্চে এসে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে “কঠোর ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া” জানানোর ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
রোববার ও সোমবার দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সরাসরি “অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি” আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সম্মেলনের প্রেক্ষাপট

গত ৯ সেপ্টেম্বর হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে কাতারে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এ ঘটনা মুসলিম ও আরব বিশ্বে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয় দোহা সম্মেলন, যেখানে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক বিকল্প নিয়ে আলোচনা হয়।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, কাতারের প্রধানমন্ত্রী, আরব লীগের মহাসচিব আহমেদ আবুল ঘেইত, ওআইসির মহাসচিব হিসেন ব্রাহিম তাহা, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মিসর, ইরাকসহ বহু মুসলিম রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা।

নেতাদের বক্তব্য

কাতারের আমির শেখ তামিম ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে বলেন—

“ইসরায়েলের আগ্রাসন স্পষ্ট এবং এটি কাপুরুষোচিত। তারা গাজা যুদ্ধের অবসান নয়, বরং আলোচনাকে ব্যাহত করার কৌশল নিয়েছে।”

ওআইসির মহাসচিব হিসেন ব্রাহিম তাহা বলেন:

“এখনই সময় মুসলিম নেতাদের ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থান নেয়ার।”

আরব লীগের মহাসচিব আহমেদ আবুল ঘেইত ইসরায়েলকে অভিহিত করেন “দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র” হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা ভাঙার আহ্বান জানান।

ন্যাটো আদলের সামরিক জোটের প্রস্তাব

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের আহ্বান জানান, যা হবে ন্যাটো জোটের মতো কার্যকর।
অন্যদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান আঞ্চলিক স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন—

“আমাদের কেবল একটিই বিকল্প আছে, তা হলো ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মুসলিমরা ভাই ভাই। তাই আমাদের এক দেহের মতো ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “শুধু ধর্ম নয়—মানবতার ভিত্তিতেই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার।”

পাকিস্তানের প্রস্তাব ও পারমাণবিক শক্তির প্রসঙ্গ

রবিবার অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার বলেন,

“আরব দেশগুলোর জন্য এখন সময় এসেছে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার, যেখানে সম্মিলিত সামরিক বাহিনী গঠন অপরিহার্য।”

তিনি আরও যোগ করেন, পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে এই সম্মিলিত বাহিনীতে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।

সম্মেলনের খসড়া প্রস্তাব

বিশ্ব সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আরব-ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনের খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে—

  • কাতারের ওপর ইসরায়েলি হামলা ন্যাক্কারজনক ও অগ্রহণযোগ্য।
  • ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি সরাসরি হুমকি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দৃঢ় জোট

ইতিমধ্যে ইসরায়েল সফর করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করে “দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা জোট” আরও শক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেন—

“যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একে অপরকে রক্ষা করবে। হামাস যেখানে থাকবে, আমরা সেখানেই আঘাত করবো।”

মার্কিন মন্ত্রী রুবিও-ও একই সুরে বলেন,

“এই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিত করতে হলে হামাস নামের সশস্ত্র উপাদানকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করতে হবে।”

গাজায় হামলা অব্যাহত, নিহত বেড়ে ২৫

ইসরায়েলি বাহিনী রোববার রাত থেকে সোমবার ভোর পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় তীব্র বিমান হামলা চালিয়েছে।

  • শুধু গাজা সিটিতেই নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন
  • পুরো উপত্যকাজুড়ে একদিনে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৫ জন
  • নিহতদের মধ্যে ৬ বছর বয়সী যমজ শিশুও রয়েছে

জাতিসংঘের নারী-শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, মাত্র ৪ দিনে গাজায় জাতিসংঘের ১০টি ভবন বোমাবর্ষণে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

২৩ মাসের সংঘাতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৬৪ হাজার ৮৭১ জন, আহত ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬১০ জন

ক্ষুধা-অপুষ্টিতে শিশুদের মৃত্যু

গাজার অবরুদ্ধ অঞ্চলে মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সোমবার নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে চারটি ভ্রূণ ও অকালে জন্ম নেওয়া তিন নবজাতক অকালে মারা গেছে খাদ্যস্বল্পতা ও চিকিৎসার অভাবে।
এতে ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত মোট মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২২ জনে, এর মধ্যে ১৪৫ জনই শিশু।

এক বাসিন্দা আল জাজিরাকে বলেছেন—

“আমাদের ঘর ছেড়ে মাত্র ১০ মিনিটের নোটিশে সরে যেতে বলা হয়। কোথাও আশ্রয় পাচ্ছি না। প্রাণীরা আমাদের চেয়ে ভালো জীবন যাপন করছে।”

দোহা সম্মেলনে মুসলিম বিশ্ব যেভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে ন্যাটোর আদলে একটি মুসলিম সম্মিলিত সামরিক জোট কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

এদিকে ইসরায়েলের হামলা গাজায় অব্যাহতভাবে প্রাণহানি ঘটাচ্ছে, আর মানবিক সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।
ফলে মুসলিম বিশ্ব এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—তারা কি কথার একতার বাইরে গিয়ে কার্যকর যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়তে পারবে, নাকি এ ঐক্যও থেকে যাবে কেবল কাগজে-কলমে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *